সাঈদা মিমি













২য়  পর্ব  পড়ুন ।

  ৩য় পর্ব   

কিসসা বুড়ির সঙিন দিলে,
রঙিন পাথর ছুড়লো কেরে? 

(কিসসাবুড়ির কথা)

কিসসা বুড়ির আসল নাম কেউ জানে না, সে বলেও নি কাউকে কোনদিন, আমরা তাকে কিসসাবুড়ি নামেই চিনি । হঠাৎ অপরিচিত কেউ তাকে দেখলে আঁতকে উঠবে, সর্বসাকুল্যে সাড়ে তিনফুট, বয়সের ভারে কুঁজো, একটা বাঁকা লাঠি নিয়ে হাঁটে, বোঝা যায় এক কালে ধবধবে ফর্সা ছিলো সে  কিন্তু মুখটা? হায় ঈশ্বর, বসন্তের দাগে বিজবিজ করছে, কোটরাগত একটা চোখ দগদগ করে জ্বলে । আরেকটা চোখ? নেই, একেবারেই নেই, পাপড়ি দিয়ে ঢাকা, চিরতরে বুজে গেছে । বুড়ি থাকে সোমেশ্বরী মন্দিরের কালিঘরে, ঐ মন্দিরের জমিনে সোমেশ্বর বাবুর দাহ হয়েছিলো, পাশেই কালিমন্দির তারপর তৃতীয় শ্রেণির সরকারী কলোনি । কিসসাবুড়ির আস্তানায় আমরা কেউ যাই না, ওখানে ভূত আছে ।

তবুও সে আমাদের প্রিয়, কারণ তার কিসসা বলার মত অনপনেয় ঢঙ আর কারো নেই । কিসসাবুড়ির কন্ঠস্বর মিহিন, সে বলার ফাঁকে ফাঁকে সুরেলা গীত গায়, ‘ওরে হাইঞ্জা বেলায় চান মিয়া শ্বশুর বাড়ি যায়, তকদির চান মিয়ার পিছন পিছন ধায়……’  কি হইলো চান মিয়ার? আরে চান মিয়া ছিলো ধনী সদাগর, হেরে খুন করার লইগ্যা হের হউর হাউরি শরবতে বিষ মিশাইলে, মরলে চান মিয়া কিন্তু তেনার আত্মার তো মউত হইলে না! আমরা শিউরে উঠি, আমাদের যৌথ দেয়ালের ভাইবোনেরা । আমরা গল্প শুনি কিন্তু বুড়ির কাছাকাছি কেউ বসি না, কিসসাবুড়ি কে আমরা ভয় পাই ।

সেই কিসসাবুড়ি দাদীর পায়ের কাছে মাথা ঠুকে কাঁদছে!  আর কিসসা কমু না ভাবিছাব, কিসসা মোরে খাইলে, এই কিসসা কইতে কইতে মোর জিন্দেগি কিসসা অইয়া গেছে । কি সেই কিসসা! আমরা অবাক বিস্ময়ে শুনি, খু ফু মোর জেবনডাই শ্যাষ হইরা দেছে ভাবিছাব, আল্হাম গেরামের পরি, হইলাম ফকিরনী, দুয়ারে দুয়ারে টোহাইয়া খাওয়া কিসসাবুড়ি । যৌবনে কিসসাবুড়ি ছিলো অপূর্ব সুন্দরী, এক ভরা সন্ধ্যায় সোনাই ব্যাপারীর উত্তর ভিটার হিজলতলা দিয়ে বাসায় ফিরছিলো সে, তখনই নজরে পড়ে খু ফু দানদানের, সেই থেকে খু ফু ভর করলো তার ওপর । 

আলাদা করে বোঝার উপায় নেই, এটা জ্বিনে ধরা রোগের মত প্রকাশিত ছিলো না, এখানে পেয়ার মোহাব্বতের লেনদেন চলছিলো । এরপর কিসসাবুড়ির বিয়ে ঠিক হলো গয়না গ্রামের মেঘা মাতবরের সাথে, মেঘা মাতবর দোজবর, বয়সও কম হয় নাই, তার নাতি নাতনি আছে । তাতে কি? টাকাপয়সার অভাব নাই তার । হতদরিদ্র কিসসাবুড়ির মা-বাপের আপত্তি ছিলো না কিন্তু আপত্তি ছিলো খু ফু দানদানের, ‘হামারা মাইয়ামানুষ তুই, অন্য কেউ তোরে ছুইলে হেরে শ্যাষ করে দিমু আমি’ খু ফু হুমকি দিয়েছিলো, রাজি ছিলো না কিসসাবুড়িও, তবু জোর করে বিয়ে দেয়া হলো তাকে । বাসর রাতেই মরলো তার বুড়ো স্বামী আর এর কয়েকদিনের মধ্যেই গুটিবসন্তের মড়ক লাগলো তার দেহে, সবাই তাকে ফেলে এলো সরকারী হাসপাতালে, যমের খপ্পর থেকে ফিরলেও ঘরে আর কোনদিনই ফেরা হলো না তার, ফেরা হলো না খু ফুর কাছেও ।

দেখেছিলো সুফি সাব যাত্রার আগে 
রক্ষাকবচ ছিলো বালিশের তলে 
( নানা জনের বচনামৃত)

 সেদিন সকালে সুফি সাহেব কে বাজারে দেখা গেছে, দুপুরে দিবানিদ্রার অবকাশ ছিলো না, তাকে যেতে হয়েছে কাশেম সর্দারের বৌ আরজিনা খাতুনের তদবিরের কাজে । আরজিনা খাতুন যখন কিশোরী ছিলো তখনই তার ওপর এক নচ্ছার দেউ ভর করেছিলো, নানান তাবিজ তুমারেও কিছু হয় নাই, এখন তার বয়স আটত্রিশ, তিনটি বাচ্চার মা, তবুও এই ঝামেলা দুর হয় নাই । সে ঘুমের মধ্যে হাঁটে, মাঝরাত্রে নিশির ডাক শুনলে দরজা খুলে দৌড়ে যায় হাস্নাহেনার ঝোপের কাছে, কার সাথে যেন কথা বলে তারপর মুখে ফেনা তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়,  তার অচেতন শরীর বলি দেয়া পাঠার মত মোচড়াতে থাকে আর মুখ দিয়ে অশরীরি শব্দ বের হয় । এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কি? খু ফু কে জিজ্ঞেস করেছিলেন সুফি সাব, এই দেউ আরজিনার রক্তে মিশে গেছে, এরা বড়ই ত্যাদোড় প্রকৃতির, জ্বিনদের আরেক নগরী কোহরামে এদের বাস । কোহরাম নগরীর জ্বিনেরা কোহকাফি দের মত আর্য নয়, সেখানে মিশ্রবর্ণের মাত্রা অধিক, এরা মানুষের সংস্পর্শ পছন্দ করে, এদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করে অবশ্যই পরিচয় গোপন রেখে, কিন্তু পরিচয়টা শেষপর্যন্ত গোপন থাকে না । এই খতরনাক ক্রসব্রীডগুলো বিপদজনক, এরা কারো ওপর আসর করলে সহসা বোঝা যায় না কিন্তু ধীরে ধীরে যখন সব প্রকাশিত হতে থাকে, তখন কিছুই করার থাকে না তেমন । এই যেমন আরজিনা খাতুন, তাকে তাবিজ কবচ বেঁধে সুবিধা করা যাচ্ছে না । সুফি সাব প্রতিদিন তদবির দিচ্ছেন নতুন মাটির সরায়, লাল কালিতে লিখে দিচ্ছেন দোয়া, সেই দোয়া পানি দিয়ে ধুয়ে খাইয়ে দেয়া হচ্ছে আরজিনা কে, সঙ্গে একটি লেবুপড়া, চুলার ওপর লেবু ঝুলিয়ে রাখা হবে সারাদিন, সন্ধ্যায় পুতে ফেলতে হবে মুরগীর খোঁয়ারের পাশে । প্রতিদিনে এর জন্য কাশেম সর্দার কে গুনতে হয় একশ ছেচল্লিশ টাকা তের পয়সা ।

বিকেলে সুফিসাব বসেছিলেন হিসাব নিকাশ নিয়ে, ব্রতিন টিপসই দিয়ে যে টাকা নিয়েছিলো, সুদে আসলে তা পাহাড় হয়েছে, হতভাগার জমিটা লিখিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই । এইরকম আরো হয়েছিলো সোনাই মোল্লা  তাইমুর ব্যাপারী  আনুমিয়া… সবার নাম কি মনে থাকে ছাই! দয়ার শরীর তার, কেউ বিপদে পড়লে সই লিখিয়ে টাকা পয়সা দেন কিন্তু বেশিরভাগ বেচাইন পার্টি তা আর ফেরত দিতে পারে না, তখন বন্ধকি জমি কিংবা গয়না সুফি সাবের হয়ে যায় । নাহে অত বোকা সে নয়, ফকিরদের দুই,চার আনা দেয় সে বটে, সুদে টাকা নয় । একবার এক হারামজাদা বলেছিলো, সুদ হারাম সুফি সাব, কতবড় হিম্মত! তাৎক্ষণিক ফতোয়া দিতে হয়েছিলো তাকে, যাদের কায়িক পরিশ্রম করার ক্ষেমতা নাই হেরা কি না খাইয়া মরবে? হেরা শর্তসাফেক্কে পুঁজি খাডাইবে, ধর্মের সব না জাইন্না কুতর্ক হরবা না মেয়া…. মনে পড়লে এখনও তার তালু জ্বলে । কিন্তু এখন উঠতে হবে, রাতে শরীফ খানের বাড়িতে মাহফিল আছে।

মাহফিলটা হয়েছিলো জমজমাট, খানাপিনা ছিলো চমৎকার, সব শেষে সুফি সাহেব কে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলো শরীফ খানের লোক,  তার পরিবারের জন্যেও খাবার টিফিন ক্যারিয়ার ভরে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো । সুফি সাহেবের গিন্নি স্বীকার করেছে, তারা এইসব সুখাদ্য খেয়ে সবাই যার যার মত ঘুমাতে গিয়েছিলো অথচ পরদিন সকালে সুফি সাহেব কে পাওয়া গেলো কাছের জলায়, পা উপরের দিকে, মাথা সহ দেহের অর্ধেক কাঁদায় গাঁথা, তার হাতে রক্ষাকবচ নেই । বেশিরভাগ মানুষের মতামত এটা খু ফুর কাজ, সুফি সাবের কারণে তার বদ জ্বিন আমদানি করা বন্ধ হয়ে গেছে । স্বল্প কিছুলোকের বিশ্বাস, গরীবদের ঠকিয়ে খাওয়ার পরিণাম এটা ।

সামছু কাকা আবার ফ্যাসাদে 
গল্পগুলি সে বলেছিলো কি সাধে? 
(সামছু কাকার গ্লানিময় স্ব-কথোপকথন)

 সব দোষ আমার, কেন আমি খু ফু কে মুক্ত করলাম? আমার বয়স কম ছিলো, মায়ামহব্বত বেশি ছিলো, আমি এই দানদানের কাহিনী সবাইকে বললামই বা কেনো! মোহর মিললো না, মদিনায় যেতে পারলাম না, যে কারখানায় কাম করি  এখন সেখানেই ঘুমাই,  বুড়ো বয়সে আমারে দেখার কেউ নাই, অভাবের কারণে সাদি করতে পারলাম না অথচ খু ফু প্রতিদিন সুন্দরীদের উপভোগ করছে, রাজাবাদশাদের লুকানো মোহর এখন তার নাগালে । খু ফু স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে, এখন অনায়াসে সে গুপ্তহত্যা করে বেড়াচ্ছে, একে একে সরিয়ে দিচ্ছে পথের কাঁটা । সেই দিনের পর আরও তিনবার সে আমাকে ভয় খাওয়াইছে, একদিন মাগরিবের নমাজ পড়ার জন্য অজু করে আসতেছি, পথ সুনসান, হঠাৎ দেখি এক ঘোমটা পড়া নারী যায়! কে? কে? বলতে বলতে আগাইলাম, দেখি মহিলাটির পা উল্টা! ইয়া মাবুদ এতো কোন মানুষের পায়ের গঠন নয়! পুনরায় অজ্ঞান হইলাম



আমি বারোমাসি পেটের রোগী,  গন্ধভাদালি পাতার রস খেয়েও কোন উপকার হয় না । সেইবার মালিক দয়া করে হাসপাতালে রেখে এলো আমারে, দুই হাতে এখনও সুইয়ের ব্যথা । আরেকবার ঘুরঘুট্টি আন্ধারে হারিকেন বাত্তি নিয়া টাট্টিখানায় গেছি, কিছুক্ষণ পরপর খালি পোলাউয়ের ঘ্রাণ পা ই তারপর কাছেপিঠে কোথাও নুপুরের শব্দ । কিয়ের টাট্টি? দিলাম দৌড়, লুঙ্গি অর্ধেক খইসা পড়ছে, এমন সময় দেখি বিশাল এক অজগর আমার দিকে চাইয়া ফিসফিস করতেছে,’ -গজনবীর নাতি তুই, হালারে তো কিছু করতে পারি নাই, তর উপরে শোধ তোলতে হবে । -আমি তরে মুক্তি দিছিলাম । হিসহিস করে হাসতে থাকে অজগর খু ফু দানদান, ‘তুই হোনস নাই, উপকারীরে হাপে খায়!  সেইবার অনেকদিন ভুগলাম, আমার মালিক লোকটা ভালো,  সারাজীবন তার কারখানায় খাটছি, আমারে নিজের বাসায় নিয়া গেলো সে, হের পরিবাররে কইলো, সামছু মেয়া এইহানেই থাকপে, মোগো পুবের ছোড ঘরডা খালি থাহে, বেডার তো পরিবারও নাই, বউ চাইরডা খাইতে দিস, কারখানার শুরু গোনে আছে, দরদ লাগে, এহানেই মরুক হালায় ।

মরণের কথা শোনলে মোর ডর লাগে, ও দাদাজান গো, আমি ডুকরে কেঁদে উঠি । শেষবার খু ফু অ্যাটাক চালাইছে পাঁচদিন আগে, মহাজনের ছোড ঘরডায় ঘুমাইয়া আছি, রাইত কত জানি না, বিষ্টি বাদলা হইতেয়াছে, কেউ আমারে ডাক দিলো, আমি দরজা খুলতে যাইয়াও খুললাম না, মরহুম দাদাজান বলতেন, ‘একডাক পর দরওয়াজা নেহি খোলনে কা হ্যায় বাচ্চে, তাহা নিশির ডাক । নিশিডাকের মোহ মারাত্মক, দিলে জোর না থাকলে কাটানো যাবে না, ঘোরের ঘোরে বের করে নিয়ে যাবে নিশি, মউৎ ও হতে পারে । আমি বাস্তবতায় ফিরে আসি, কে? প্রেশ্ন করি বারবার, আর কোন ডাক নেই সাড়া নেই । দরজার ডাসা ভালোমত ঠেইসা শুইতে যামু, এমন সময় পড়লে বিকট এক ঠাডা,একদৌড়ে ঢুকলাম লড়বড়ে টেবিলের নীচে । আবারও পড়লে! আরো একটা, তারপর চড়াৎমড়াৎ শব্দ, হইতেয়াছে কি! শিমুল গাছের একটা তিনফাডা ডাইল আমার চাল ভাইঙ্গা পড়লে বিছানার ওপর, পরদিন নিজেরে পাইলাম সদর হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে ।

ঘুরিয়া দাঁড়াইতেই হবে, মহাজন আমারে দিয়া গেছে স্বরূপকাডি, আমার সৎ ভাইয়ের বাসায়, ভাইজান তালাল কুতুবি মানুষটা এক্কেরে খারাপ না, ঘোরপ্যাঁচ অবশ্য ভালোই বোঝে, তিনতিনডা আরতের মালিক, আমারে বসাইয়া দেলে একটায় । এখন আমি আগের চাইতে সুস্থ, পেলান সাজাইতেয়াছি, খু ফুরে বন্দি করতেই হইবে । আমার লগে রক্ষাকবচ আছে, ঐ হতচ্ছাড়া সুফি সাবের দেওয়া মাদুলি না, হালায় আছেলে ভণ্ড আর চামার, একবার কয়ডা টেকা চাইছিলাম, আমি গরীব, জমি জিরাত নাই, হালায় দেলোই না! মরছে কিন্তু আমি খুশি হই নাই, ওডা কুমরা । এইয়া খু ফুর কাম নিশ্চিত! আবার মোর কইলজা কাঁপে কিন্তু আমার ডাইন বাজুতে ইনসাফ পিরের দেওয়া কবচ আছে, ভয় নাই । হের লগে আমার কথা হইছে, যে মাসে দুইডা অমাবশ্যা পড়বে সেই মাসেই খু ফুরে আটকানো হবে । খুফু দানদান, অপেক্ষা কর, আর উল্ডা দিক দিয়া দিন গোনা শুরু কর, একদিন আমিই তরে মুক্তি দিছিলাম, আবার আমিই তরে আটকামু ।

আমার মুখে ছুঁড়লি মদ? 
তুই একটা চিমসা বদ… 
( দেলার বাপের মড়াকান্না)

সেদিন জুয়া হাঁড়িয়া আর মেয়েমানুষ তিন মিলে জম্পেস রাত জমে উঠলো, ‘শ্বশুর জামাই বন্ধু ভাই, একপাত্রে মজমা জমাই ।‘ এদিকে রাত ঢলছে, দেমাগ টলছে, এমন সময় ইয়ার খু ফু দানদানের কথা মনে পড়লো দেলার বাপের, আরে সর্বনাশ, আজ তো ওস্তাদেরে ভোগ দেয়া হয়নি! এসবের মধ্যেই পশ্চিম কোনার মাদুরে চোখ গেলো তার,  খু ফু বসে আছে, চিন্তিত মুখ, আজ মাথায় পাগড়ি নেই, দাঁড়ি চুলে মাখামাখি উদভ্রান্ত চাহনি,  কি হয়েছে ওস্তাদের? ভাবতে ভাবতে দেলার বাপ এগিয়ে যায় তার দিকে। অতিরিক্ত পান হেতু দেলার বাপের মগজ যথেষ্ট অস্থির এবং কিছু আগে আহ্লাদ করে আসা পুরুষ্টু নারীটির ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এসবের মধ্যে খু ফু পীরের আলুথালু চেহারা! নুরাণী ভাবের ঠমক কই? তাহলে কি হুজুর আজ পান করেছে শরাবনে তহুরা! একই পথের পথিক হতে পেরে আনন্দের আবেশ তাকে বিবশ করে দিতে থাকে, এই অবস্থায় হাতের গেলাসটা নিয়েই খু ফুর পাশে বসে দেলার বাপ, -কি হইছে হুজুর? আমনেরে পেরেশান দেখতেয়াছি! -আমারে ফান্দে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে, বোতলে আটকাইবে? বোতল… বোতল…. দেলার বাপ বুঝলো আরেক গল্প, হুজুরে আইজ বোতল চায়! বাজারের ব্যাগে লুকিয়ে রাখা ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা নিয়ে এলো সে, ওস্তাদের ভাণ্ডার থেকে সরিয়েছে, আজ এটা দিয়েই ‘মহামহিম জ্বিনমানব, পীরে ইলাহি খু ফু দানদান কে সম্মানিত করবে সে । 

ঠিকমতই এগোচ্ছিলো, আঙুরের তরল ঢালা হয়েছিলো গেলাসে, মেশানো হয়েছিলো রঙহীন জল, সামনে ছিলো চানাচুরের বাটি, কেবল খু ফুর দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দিতেই উষ্ঠা খেলো সে, শরাব ছিটকে পড়লো দানদানের মুখে, ক্রোধে কেঁপে উঠলো খু ফু,আমার মুখে ছুড়লি মদ? তুই একটা চিমসা বদ, গোষ্ঠের কাননে ছিলি বুঝবি এবার, ক্ষয়রোগে খাবে তোরে উটকা  আবাল ।‘ চমকে ওঠে দেলার বাপ, এ কোন অশুদ্ধ বচন হুজুরের মুখে! 

দেলার বাপ বাড়িমুখো, আজ জামাই বাবাজি সঙ্গে নেই । গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে ঘন্টা পড়তেই চমকে ওঠে দেলার বাপ, সর্বনাশ, এতো সুবহে সাদিকের আগ মূহুর্ত! ঠিক আধাঘন্টা স্থায়ী হবে সময়টা, একে বলে কালিরাত, এই সময় প্রেতদলের বৈঠক বসে! কি করবে সে এখন? প্রেতলোকের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে, এদের সামনে কোন মানুষ পড়া মানেই, ইহজনমের জন্য আত্মা বিক্রী করা নচেৎ মরণ । দেলার বাপের পরকাল সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই, সে ধর্মকর্ম করলে হয়তো ওয়াজ মাহফিল মারফৎ কিছু জানতে পারতো, আজ অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তাহেতু লুঙ্গিও খোলা হয়নি, নয়তো পেশাবের চক্রব্যুহো তৈরি করতে পারতো, অতিরিক্ত পান ও ভোগ এবং খু ফুর কথাবার্তা তাকে আউলা করে দিয়েছে তাকে। অবশেষে লুঙ্গিই হলো কাল, সেটাতে প্যাঁচ লেগে খানবাড়ির নালায় পড়লো সে, তারপর আচানক উল্টে ভাঙ্গাচোরা স্পিডব্রেকারের ওপর । তাকে দেখতে পেলো ভোরের নামাজিরা, খবর গেলো দেলার মায়ের কাছে । ধরাধরি করে ঘরে আনা হলো দেলার বাপ কে, অজ্ঞান মুখ দিয়ে ফেনার গ্যাজলা ।

দেলার বাপের জ্বর একশ চার, নামছে না,  হাকিম বদ্যি চলছে, এরধ্যেই একদিন পুলিশ এসে হাজির, জহের মিয়ার সন্ধানে । জহের গায়েব দুর্ঘটনার রাত থেকেই, কি করেছে সে? চাঁদাবাজি? সে তো সবাই জানে, যেটা জানতো না কেউ সেটাও জানলো, খুন করেছে জহের মিয়া, উকিল বাদশা খোনকারকে । পুলিশ দেলার বাপের বাসায় তাকে পেলো না বটে কিন্তু সে ধরা পড়লো নরসিংদীতে। সবকিছু ভেঙে পড়ছে, হাহাকার আর মাতম শুরু হয়েছে দেলাদের ঘরে, দেলার মা তিনটে বাসায় কাজ নিয়েছে আর দেলা রাতের সজ্জায় অলিগলিষ ধান্ধায়।

কা মুই হুজুরেরে অপমান করলাম? হের মুখে মদ ফেকলাম কোন দুক্কে? ওরে মোর তকদির, এহন মোর কি হইবে রে…. দেলার বাপের কান্নায় আসমান জমিন ফাটে না, মানুষের মনও গলে না, দুই কামরার বস্তিঘরের ভাড়া টানবে কে? আবার ফাঁটাফুটো একরুমের ঝুপড়িতে উঠে আসে তারা । দেলার বাপ কাজে যেতে পারে না, সে ভয়াবহ অসুস্থ, তার জ্বর কমছে না, পানাসক্ত দেহ মদের অভাবে মুচড়ে ওঠে, শুরু হয় খিচুনি, পেট ফুলে ঢোল, রক্তবমি, কঠিন আমাশা, কে টানবে একে? দরিদ্র পরিবারটা ভুলে যায়, তাদের সুদিন এসেছিলো, তারা জেনে যায়, দেলার বাপ খু ফু কে রুষ্ট করেছে । ক্রমশ দেলার বাপের রক্তবমি বাড়তে থাকে, সাথে ঘুসঘুসে কাশি, বস্তিবাসী শংকিত হয়ে পড়ে, এতো ক্ষয়রোগ! শেষতক সবাই একজোট হয়ে তাকে রেখে আসে সরকারী যক্ষা হাসপাতালে। ( আগামী সংখ্যায় ) 

- ঢাকা - 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.