শ্রীশুভ্র













আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না! জানলার নাগরিক ফাঁক দিয়ে যতটুকু চিলতে আকাশ দেখা যায়, ততটুকুর গোনাতুনতির পরিসরে না কবি; তোমার সেই চঞ্চল সজল পবন বেগে উদভ্রান্ত মেঘে মন চাওয়ার মতো অবসর আর কই? অবসর নেই, কিন্তু সেই মন? তাও কি আর সেরকম আছে? বলাকার পথখানি চিনে নিতে? নয় রাজি। নয় রাজি। এই বৃষ্টি এই অঝর শ্রাবণের আমন্ত্রণে দূয়ার কাঁপে কই কবি! ক্ষণে ক্ষণে? একলা বসে ঘরের কোণে, কি হবে ভেবে আমার- ‘সজল হাওয়া যূথীর বনে কি কথা যায় কয়ে’? আমি শুনছি টিভির বাণী, কোথায় কতো জল! এক হাঁটু না গোড়ালি ভেজা! কোন নদীতে ছাড়তে পারে কত কিউসেক জল! এই শ্রাবণের মলিন দিনে এই বৃষ্টির ঢল গৃহকোণে আটকে রাখে কবি! তাই ঘরের বাঁধন ছিন্ন করার কথা দূরে থাক, কত মানুষ এই সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য আকুল ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয় নাগরিক জানালার এপাশে। তবু আমার ব্যাকুল মন আজ উতলা এই বৃষ্টি ভেজা ছাঁটে। এই সময় এই শহর এই জীবন এই বৃষ্টির মত নাচতে পারে কই কবি? বাদল বাউলের একতারার সুরে মন আর মজে কই্!

মজার মতো মনটাই তো আজ মজে গিয়েছে। সে মনে বাদল বাউল একতারা বাজাবে আর কি করে? লোভ আর স্বার্থের রেলিং ঘেরা এই ইট কাঠ পাথরের মতো মুখস্থদিন প্রেমের প্রদীপ নয়, শুধুমাত্র প্রয়োজনের সলতেটুকুই ধরিয়ে বসে থাকে। যে সলতে থেকে আগুন ধরিয়ে আমরা আমাদের আকাঙ্খার মশালগুলি দাউদাউ করে জ্বালিয়ে নিয়ে চলেছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সে মশালের দহন তাপে আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাও পুড়তে থাকে ঝরো ঝরো ধারার উৎসরনেও। এই বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ শহরের বুকে ম্যালেরিয়ার চাষ করতে পারে বরং, ওষুধ কোম্পানি থেকে ডাক্তারের ঘর আলো করে অচঞ্চলা লক্ষ্মীর চওড়া হাসি ভেজে না শ্রাবণের ছাঁটে। এই তো আমাদের মনের নিভৃত ছায়াবীথিতল, সেখানে বাজায় না বাদল বাউল একতারা আর। কি করে তাই বলি, বলো কবি, ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করে স্নান নবধারাজলে’

তাই আজ ঝোরো বৃষ্টির ঝরো ঝরো শ্রাবণের এই রাতে কোথায় অভিসার? পরানসখা বন্ধুর? মেঘনীলবেশে! আকূল করা কোনো ব্যাকূল হৃদয়ে? দূয়ার খুলে প্রিয়তমার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষার রাত নয়, বাহিরে নয়, আজ অন্তরেই বার বার খুঁজে দেখি আর পথ নেই কোনো। নাগরিক অরণ্যে আমরা সত্যিই যেন পথ হারিয়ে ফেলেছি কবি। তুমি বলেছিলে দাও হে অরণ্য লও হে নগর; আজ যেন শ্রাবণের এই ময়ুরের মতো নাচা রাতে বেশি করে মনে পড়ছে তোমার সেই তীব্র প্রার্থনা কবি। কিন্তু তবু হৃদয় আর নাচতে পারে কই? কেমন অসাড় হয়ে গিয়েছে অনুভবের ইন্দ্রিয়গুলি। শুধু চাওয়া পাওয়া শুধু দেওয়া নেওয়া শুধু লাভক্ষতির নিক্তিমাপা ক্ষতিয়ান ছাড়া আর কোনো পথের হদিশ পেলাম কই?  পথ নেই পথ নেই! পথ রেখা গেছে মিশি নাগরিক কংক্রিটে! তাই ‘যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়!’ এই আবিশ্ব নৃত্যের তালে তালে অসাড় মন আর নাচতে পারে না নাগরিক বেডরুমে! যেথায় বাজে বিশ্বের বাঁশি- সেখানে পৌঁছানোর মতো কোনো প্রত্যয় অবশিষ্ট নেই আজ আর। মনে হয় মায়াবিনী এই জীবনের ছলনায় বাঁধা পড়ে গিয়েছি! মুক্তি নেই! মুক্তি নেই! কবি তুমি জানতে আগে থেকে! তাই কি বলে গিয়েছিলে,-

“ আসন্ন নির্জন রাতি, হায়, মম পথ- চাওয়া বাতি
ব্যাকুলিছে শূন্যেরে কোন্ প্রশ্নে।।
দিকে দিকে কোথাও নাহি সাড়া,
ফিরে খ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া।
নিবিড়-তমিস্র-বিলুপ্ত-আশা  ব্যাথিত যামিনী খোঁজে ভাষা—
বৃষ্টিমুখরিত মর্মরছন্দে, সিক্ত মালতীগন্ধে।।“


তাইতো কবি, এযুগের ধারাভাষ্যকারদের আর আসা হলো না ‘মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে’। হয়তো তাই কোথাও কোনো অসতর্ক মুহূর্ত্তে সজল মেঘের ছায়ায় পথ হারানোর বেদনা আজো বেজে চলে কোনো বিজন হৃদয়ের নিভৃত নির্জন নিবিড় রাতের সঙ্গোপনে! কে জানে!

- বর্ধমান - 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.