
বর্ষা রানি ছল ছলানি এবং ঢলানি সারাদিন ঝুপ ঝুপ, টুপ টুপ , সোঁ সোঁ , হুঁশ হাঁস নানা বিধ ঢঙে এবং রঙে পাড়া মাতাচ্ছে । এই যদি মনে হয় ভরন্ত যৌবনা কামিনী রঙ্গে বিভোর , তো এই দেখি চপলা কিশোরীর বেণী দোলান , গাল ফোলান অভিমান , দুষ্টুমি ।
ও আমার শৈশবের ভাব আড়ির পুতুল পুতুল সঙ্গিনী , কৈশোরের গোপন অভিসন্ধি পাকানোর দুরন্ত দামাল সখি , বয়ঃসন্ধি বেলার গোপন গোপন ভাবনার জটিল পরামর্শ দাত্রী , যুবতি বেলার শরীরের আনাচ কানাচে শিহরন জাগানো মধুর পরশ । জানালার কাঁচের ওপারে ঝাপসা মেঘ মুলুক মার্কা পটভুমিকায় বিশ্ব তরঙ্গে এবং ঘরের ভেতর আমার জীবন রঙ্গে খুব একটা বৈপরীত্য দেখি না, ও যে কোন নিয়ম নীতির ধার ধারে না , জানে না, বারন শোনেও না ।
চল বৃষ্টি আমার ফেলে আসা খেলাঘর , ভাঙাচোরা খেলনাপাতি আর শৈশব স্মৃতি ভেজে রোজ যেখানে, যে স্যাঁতস্যাঁতে কোণে শ্যাওলা জমেছে অনাদরে, হয়ে যাক কুমির ডাঙ্গা । তুই কু দিস আমি আবার খুঁজবো কিছু সোনা ,রূপো , পেতল বর্ণ দিন ।
বর্ষার কারনে বিরক্তি ব্যাপারটা আমার অবিশ্বাস্য মনে হয় । আমি তো বেশ ভাবতে পারি আমার সেই কাগজের নৌকো ভাসাবার জন্য উন্মুখ দিনগুলো । প্রথমে বাবার বানিয়ে দেওয়া তারপর ক্রমশ শিখে নেওয়া সেই অলৌকিক ভাঁজ ভঙ্গিমার কৌশল , এখনও বানাই , আমার তনয়ার জন্য। একই রকম আনন্দ , একই রকম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । আমি দেখতে পাই এক স্কুল ফেরত কিশোরী বেণি ভিজিয়ে পরমানন্দে জল ছপ ছপ পথে যথাসম্ভব দেরি করছে , ভাবছে কোথায় কোন গলিতে আরও বেশি জমা জল পাওয়া যাবে , জলের ওপর ছাতা উলটে হাতল ধরে টানা যাবে মনের সুখে। সে জানে হাইজিন বইএর পাতায় থাকে , ওসব মানার বিষয় নয়। আর একটু বড় হয়ে সাইকেলের সওয়ারি যখন, চাকার দুপাশে ছর ছর শব্দে জল সরছে কি উল্লাসে । বৃষ্টি মানে আড়াল খোঁজা কে বলেছে , বৃষ্টি মানে ভেজার নেমন্তন্ন , না জানিয়ে এলে আরও উল্লাস । সুমন যে কি সব বলে , নোংরা জল , আর ভেসে যাওয়া ঠা৺ই , আহাম্মক না কিসব যেন,ভাগ্যিস ওসব সচেতনতা আরও পরের গল্প , এখনও কিন্তু এসব ঝঞ্ঝাট মাথায় রেখেও শ্রেণী , সমাজ ,সব ভুলে যাই ক্ষণকালের জন্য । আমার চির সখা জরিয়ে ধরলে , টানা বসত করলে আমার পাড়ায় আহা কি অপূর্ব বেঁচেথাকা । যে ভিজতে ভয় পায় তাকে অকাতরে ছাতা , বর্ষাতি দান করি আজকাল , বিবেক দংশন কাটানোর ধান্দা আর কি ! আমার সাহায্যকারী আসতে না পারলে বেমালুম ক্ষমা করে দি। কুকুর বেড়াল , মানুষের কাঠামো ভিজলে খুব নিদারুন- কষ্টটাকে লাঘব করার চেষ্টাটাও এই বুড়ো বয়সের উপদ্রব। তা সত্ত্বেও বৃষ্টিকে বেপাড়া চলে যেতে দেখলে মন খারাপ লুকিয়ে রাখতে পারিনা।
আমার জীবনসঙ্গী পেটুক মানুষ, এতটাই যে মাঝে মাঝে মনে হয় মস্তিষ্ক টাকে পেটে পুরে রাখে কিনা । সুতরাং আম জনতার বর্ষা মঙ্গল কাব্য যেমন খিচুরি ইলিশে শুরু এবং শেষ হয় ওর কাছে আবার তার পর্যায় সারণি শুনতে পাই । টিপ টিপ , ঝম ঝম , সোঁ সোঁ , না না শব্দের বৃষ্টির রকমারি রেসিপি । নানা বিভঙ্গের বৃষ্টির নানাবিধ সঙ্গম ভঙ্গিমা যেন ...
বয়েস বাড়ছে টের পাই, আমিও যখন আমার মায়ের সুরে মেয়েকে ভিজতে বারন করি , আর নিজে খুঁজে বেড়াই ভেজার নানা বাহানা। কি সব যে ভীষণ জরুরি কাজ পরে যায় আমার বৃষ্টি নামলেই ।
একটু হলেও মিথ্যে রয়ে যাবে যদি না বলি মুদ্রার অপর পিঠের কথা । হ্যাঁ , বৃষ্টি খালি জানে আমার গোপন দুঃখ , অসুখ , না পাওয়া , ভুল চাওয়া , হেরে যাওয়া , হারানো , পেয়ে হারানো ... আমার কত অঝোর বর্ষণ কি মমতায় মিশিয়ে নেয় ও ওর ধারায়। আমার নিজস্ব শ্রাবণ , প্লাবন আর পার ধ্বসার শব্দ কি পরম বিশ্বস্ততায় লুকিয়ে রাখে ও । এক মেঘবালিকার গোপন অভিসার, তার উড়োচিঠি ঠিকানা হীন রাখা আছে মেঘের লেফাফায় , না, কি লেখা আছে তাতে কেউ জানবে না কোনোদিন । বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে যে সেসব লেখা !
- রায়গঞ্জ -
সুচিন্তিত মতামত দিন