ফারহানা খানম













বেশ সুন্দর বাতাস বইছে থালার মত বড় রূপোলী চাঁদ ও উঠেছে আজ, চা খেতে খেতে নিতু আকাশের পানে চেয়ে নিজের মনেই বলল দারুন জ্যোৎস্না হবে আজ । চা শেষ করে কাপ নিয়ে ঘরে এসেই ও ভুলে গেল সব ।  এদিকে মনোযোগ দেবার সময় নেই অথচ এক সময় চাঁদনী রাত কি ভালোই না বাসত । ছাদে বসে গান করত সবাই  মিলে ...

এই বিকেলের  চা  খাওয়া শেষ হলতো এখনই  কাজে ডুবতে  হবে ওকে ।

রান্না ঘরে এসে চাপ প্লেটগুলো ধুয়ে রাখে । আজ কয়দিন রিতাকে এসময় পাওয়া যায় না শুয়ে থাকে।  কি জানি হয়ত শরীর খারাপ লাগছে অন্যসময় রিতাও ওকে রান্নার কাজে খুব সাহায্য করে ।  ফ্রিজে তরকারি পেঁয়াজ কেটে রেখে গেছে বুয়া সেগুলো বের করে   উনুনে  রান্না বসায় নিতু ।

রিতা শুয়ে থাকে ইদানিং তার অনেক গন্ধই সহ্য হয়না পেঁয়াজের তো একদমই না খুব বমি উগ্লে আসে । আজকাল খুব বমিও হচ্ছে ওর ।প্রথমে ভেবেছিল জন্ডিস কিন্তু তারপরই ভুল ভাঙল । স্টিক এনে ইউরিন টেস্ট করেছে ও । তাতেই নিশ্চিত হয়েছে সে ।

এসে মৌ’কে নিয়ে  পড়াতে বসে  নিতু ,  মাহিম পাশের টেবিলে একা একা পড়ছে । এই দুই ছেলে মেয়ে ,আর ওদের বাবা নাজিব এই চারজনের সংসার ওদের ,আর একজন আছে এই সংসারে সে  রিতা । নিতুর দূর সম্পর্কের বোন । বাবা মারা গেছে একলা মা গ্রামে থাকেন ।  খুবই গরীব । গ্রামে এতবড় মেয়ে নিয়ে একা থাকাও সমস্যা তাই নিতু ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে তাতে ওরও সুবিধে হচ্ছে ।  বাচ্চাদের দেখা শোনা করার পাশাপাশি সে  পড়াশুনা করে  প্রাইভেটে এবার বি এ পরীক্ষা দেবে ।

নিতু’র পড়াতে পড়াতে একসময় মনে পড়ে উনুনে  তরকারী দিয়ে এসেছে ।  রিতাকে ডাকতে থাকে রান্নাটা দেখতে । কয়েকবার ডাকার পরেও রিতার সাড়া নেই দেখে  নিজেই ওঠে । রান্না ঘরে যায় সব ঠিক ঠাক করে । ফেরার পথে চোখে পড়ে  রিতা । ওর চোখে মুখে পানি ।  নিতু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে কিরে কি হয়েছে তোর ? এই অসময় মাথা ভেজা কেন ?

''না আপু কিছু না বেশ গরম লাগছিল তাই একটু হাত মুখ ধুয়ে এলাম মাথায়ও পানি দিলাম '' । বেশ যা এবার মুছে নে ,  না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে ।  যাচ্ছি বলে চলে যায় রিতা । নিতু আবার পড়াতে বসে ।  দুজনেরই পরীক্ষা চলছে মৌ পরে ক্লাস টু ‘তে আর মাহিম ক্লাস সেভেনে ।  ওর অবশ্য প্রাইভেট টিউটর আছে তবুও পড়ার সময় নিতু কাছেই থাকে ।

ওদিকে ল্যান্ডফোনটা  বেজেই যাচ্ছে অনবরত ।  নিতু ভাবছে কে ফোন করলো ? আজকাল সবাই প্রায় মোবাইলেই ফোন করে । উফফ ! রিতা ধরছে না কেন এখনো  ? বিরক্ত হয়ে  নিজেই উঠে গিয়ে ফোন ধরতেই  ওদিক থেকে  কোন কথা শোনা গেল না । অগত্যা আবার এসে বসলো বাচ্চাদের কাছে ।  একসময় পড়া থামিয়ে  মৌ বলল , --মা তুমি জানো রিতা খালামনির খুব পেটে ব্যাথা আর বমি হচ্ছে দু দিন থেকে তুমি বকবে তাই বলেনি তোমাকে ।  কাল আমি দেখে ফেলায়  , আমাকে বলল তোমাকে যেন কিছু না বলি ।

মাহিম খুবই বিরক্ত হল মেয়েটা খুব বেশি বেশি কথা বলে অসুখ কি এমনি এমনি হয় ? মাহিম সব জানে মাঝে মধ্যেই দুপুর বেলা খালামনি বাইরে যায় ফেরে ২/৩ ঘণ্টা পর ।  মাহিমকে বলে যায়  মৌ’ এর দিকে খেয়াল রাখতে ! কোথায় যায় রোজ রোজ ?  নিশ্চয় বাইরে খেয়ে কোন অসুখ বাঁধিয়েছে ।  যখন  বাসায় কেউ থাকে না বুয়া কাজ সেরে চলে যায় মাহিম একা একা মৌ কে নিয়ে থাকে । কিন্তু এটাও ঠিক গত কয়েকদিন খালামনি বাইরে যায়নি ।

নিতুর খুব খারাপ লাগছে  মৌ এর কথা শুনে রিতা এমন কেন ভাবে ? ওতো রিতাকে নিজের বোনের মতই দেখে । শুধু ও যখন অফিসে থাকে তখন বাচ্চাদের একটু খেয়াল করতে হয় রিতাকে এ ছাড়া তো বাসায় কাজের বুয়া আছেই । দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতু । নাহ!  কিছুতেই এই মেয়ের সঙ্কোচ কাটল না এতদিনেও ।

নিতু উঠে  রিতার ঘরে যায়  দেখে আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে ।  নিতু খাটে বসে মাথায় হাত রাখতেই চমকে ওঠে রিতা ।
---কি হয়েছে রে তোর ? শরীর খারাপ ? আগে বলবি না ?  ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেতে হবে তো ।
---না আপু কিছু না তুমি ভেবো না এমনি ঠিক হয়ে যাবো ।
---হলেই ভালো ,বেশি কষ্ট হলে বলিস । নিতু ফিরে যায় কাজে ।  রিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । মনে মনে সে খুব কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেয় ,এবং  খুব শীগগিরই  সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে ।  তার আগে আর একবার শেষ বোঝা -পড়া করতে হবে সে জন্য দুই দিন সময় চাই ওর । এদিকে কলিং বেলে টুং টাং ...  ভাইয়া ফিরেছে । কেন যেন উঠে দরজা খোলার ইচ্ছে হল না ,শুয়েই রইল ।

খেতে বসে রিতা কিছুই খেল না ,ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লো , নিতু আর নাজিব বেশ অবাক হল এই এক বছরে রিতার এরকম ব্যাবহার এই প্রথম ।  যেন কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে ওদের ।

পরদিন , অফিস থেকে ফিরেও রিতার অবস্থা একই রকম দেখতে পেল নিতু ।  আজ বরং আরও খারাপ মনে হল ওকে  । কেমন যেন খুব চিন্তিত আর অন্যমনস্ক ; নিতু নজরে রাখল রিতাকে বিকেল থেকে রাতে ।  বাচ্চাদের  খাইয়ে এসে রিতার ঘরে যখন  ঢুকল  তখনো নাজিব ফেরেনি ও নিতু চায়না নাজিবের সামনে এসব কথা হোক ।

ক্রমশঃ সন্দেহ দানা বাঁধছে ।  তাহলে কি সবার কথাই সত্যি ।  রিতাকে  যখন এ বাড়িতে  নিয়ে আসে  তখন অনেকেই এমন কি রিতার মা’ও নিতুকে বলেছিলেন  ''এতবড় মেয়েকে ঘরে জায়গা দিচ্ছ চোখে চোখে রাখতে পারবে তো ? '' নিতু পাত্তা দেয়নি কিন্তু কাল রিতার ব্যবহার দেখে ও ঠিক বুঝেছে কি অসুখ করেছে ওর ।  নিতুর আকস্মিক প্রবেশেই রিতা ধড়ফড় করে বসলো ।


---রিতা সত্যি করে বল কি হয়েছে ? কেন খেতে পারছিস না ?
রিতা কাঁদতে কাঁদতে বলে আপু আমি চলে যাব । তুমি কিছু ভেব না তোমাদের কিছু হবে না ।
---সেতো যাবি’ই ।  কিন্তু তার আগে বল কি করে এমন হল ? কে করল ?

বলতে গিয়ে  চকিতে চোখের সামনে নাজিবের অবয়বটাও ভেসে উঠলো ও নয়ত ? কিন্তু কি করে সম্ভব ? আবার ভাবল মানুষ যখন অমানুষ হয় তার দিয়ে সবই সম্ভব । ভাবতেই তীব্র ঘৃণা অনুভব করল নাজিবের প্রতি ছিঃ ছিঃ ওনা দুই সন্তানের বাবা!  কি করে পারলো ও এমন করতে ? নিতু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না কাঁদতে কাঁদতে বলল আমিই এ বাড়িতে তোকে এনেছিলাম বুঝিনি আমারই ঘরে এসে তুই আমার ঘর ভাঙবি ।  এসময় সদরে কলিং বাজতেই নিতু পাগলের মত বেড়িয়ে গেল  ; অন্ধকার ঘরে রিতা লজ্জায় মরে যেতে থাকে আপু শেষ পর্যন্ত ভাইয়াকে নিয়ে সন্দেহ করল ''
দরজা খুলেই নিতু ঝাপিয়ে পরে নাজিবের ওপর বলতেই থাকলো  তুমি এত নিচ ! এত লালসা তোমার ! আর কত কি ; নাজিব কিছুই বুঝতে পারেনা শুধু এক সময় বিরক্ত হয়ে নিতুকে জোর করে সোফায় বসিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে ? শান্ত হয়ে সব বল ।

ওঘরে মাহিম তখন ভাবে ইসস সবাই আমাকে এত ছোট ভাবে কেন ? মামনি আমার কাছে কিছুই জানতে চাইল না অথচ আমি সব জানি খালামনি চুপ করে আছে মাঝ থেকে আব্বু - আম্মু ঝগড়া করছে ।
সব শুনে অবাক হয় নাজিব রিতার প্রতি ভীষণ রাগ  অনুভব করে ভাবে ''ও কি করে পারলো আমাকে সন্দেহ করতে ?ওর মন এত ছোট ! কি হচ্ছে এসব ? আচ্ছা যদি ওর কথা সত্যি হয় তাহলে আসল শয়তানটা কে ? ফ্রেশ না হয়েই – না খেয়েই  সারারাত বসে থাকে নাজিব ।  পাশের সোফায় নিতুও ।

সকাল হতেই রিতা ব্যাগ গুছিয়ে  নিতুর সম্মুখে ।
---আপু আমি যাই ।
নিতু চমকে ওঠে আরও একবার । ওপাশ থেকে  নাজিব বলে ওঠে যাবে তো বটেই তার আগে বলে যাও কে এই নাটকের নায়ক ? আমাদের সংসারটা এলোমেলো আর অনিশ্চিত করে দিয়ে  তুমি এইভাবে যেতে পারবে না ।
---বল কে সে ?
রিতা চুপ । নাজিব হুঙ্কার ছাড়ে । ওর এই রাগকে নিতুও খুব ভয় পায় সেও বলে
--বল কে সে ?
একটু চুপ থেকে উদাস কণ্ঠে  রিতা বলে,  সাদিক ।
নিতু চিৎকার করে ওঠে ...  কি  বললি তুই ? শেষ পর্যন্ত ওদের মাষ্টারের সাথে এরকম করলি ?  আমাদের মান সন্মান তোর নিজের মান সম্মান কিছুই ভাবলি না ? এখন তোর কি হবে ? কে বিয়ে করবে তোকে ? আর কখন এত কাণ্ড ঘটালি ? হায় ! আমি কি বোকা একটুও কিছু জানতে পারিনি ,তোকে মহুর্তের জন্যও অবিশ্বাস করিনি তার বদলে আমার ঘরেই এই পাপ করলি ?
নাজিব বলে শান্ত হও নিতু এখন ওসব বলে কোন লাভ নেই ।
রিতা খুব শান্ত হয়ে উত্তর দেয় কি আর হবে  আমার ? আত্মহত্যা করব আমি ।  আর এই পবিত্র ঘরে অপবিত্র কিছু ঘটেনি আপু !

নাজিব উচ্চস্বরে ...   চুপ করে বস এখানে । একটু পর আমি সাদিক কে ডেকে এনে তোমাদের বিয়ে দেব ।
বিয়ে আমরা আগেই করেছি ভাইয়া কিন্তু ওর  চাকরি নেই বলে ও এটা মানতে পারছে না ।  সে আমার সাথে কথা বলছে না । বার বার জোর করছে যেন ...আর কিছু বলতে পারল না রিতা কাঁদতে থাকলো ।

নাজিব বলল বুঝেছি তুমি চুপ থাকো আমি দেখছি সব ।
নিতুও চলে যায় ঘরে ওর বুক থেকে যেন ভারী একটা পাথর নেমে যায় , তার বিশ্বাস নষ্ট হয়নি এখনো । এদিকে কাল থেকে  অনেক কাজ পরে আছে এখনি হয়তো বুয়া চলে আসবে ।  এসময় সিঁড়িতে খুব চেনা পায়ের শব্দ শুনে চমকে ওঠে মাহিম  ! যাক স্যার এল ঠিক সময়েই  ......।

- ঢাকা - 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.