“বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়”
-কাজী নজরুল ইসলাম-
পরাধীন ভারতের সেই তুর্যবাদক, বিদ্রোহের কেতন ওড়ানো বাংলার চিরবিদ্রোহী কবি জাতির জীবনে ধুমকেতুর মতোন দেখা দিয়েছিলেন অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর মতই। পরাধীনতার অভিশাপে ন্যুব্জ জাতির মেরুদন্ডে জ্বালতে চেয়েছিলেন বিদ্রোহের আগুন। জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন অকুতভয়ে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে, শ্রেণীবৈষম্য ঘুচিয়ে দিয়ে শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডাক দিয়েছিলেন তাঁর সেই তুর্যবীণায়।
“হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষানের স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম”।
কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে জীবনের শেষ অভিভাষণে(যদি আর বাঁশি না বাজে); বলেছিলেন নজরুল।
ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, কাজী নজরুলের সেই ভাষণের কযেক বছরের মধ্যেই বাংলা জুড়ে লাগানো হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আর যিনি এসেছিলেন সর্বপ্রকার ভেদাভেদ দূর করতে, তাঁর নিজের দেশ, মাতৃভূমিই হিন্দু মুসলিমে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল ঐ অভিভাষণের মাত্র সাত আট বছরের মধ্যেই, ১৯৪৭ –এর ১৪ই আগষ্টের সেই কালরাত্রিতে! আর আমরা বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমানরা বিদ্রোহী কবিকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে হিন্দুত্বের কাছে, ইসলামের কাছে, বৃটিশের স্বার্থের কাছে সেদিন বিসর্জন দিলাম আমাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতা, বাঙালির সার্বভৌমতা! আমরা ভুলে গেলাম, “ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!” আমরা সেদিন দুহাত তুলে, আমাদের হিন্দুত্ব নিয়ে, আমাদের ইসলাম নিয়ে নৃত্য জুড়ে দিলাম! ফিরেও দেখলাম না ফুলের জলসায় নীরব কবির সকল প্রচেষ্টা প্রয়াসকে আমরা ইতিহাসের কোন আস্তাকূঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম সেদিন? এই আমদের নজরুলপ্রেম! চিরবিদ্রোহী কবির প্রতি এইতো আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য!
প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুলই প্রথম বাঙালি কবিসাহিত্যিক, যিনি হিন্দু মুসলমান সমগ্র বাঙালি জাতিসত্বারই প্রতিমূর্ত্তি। তাঁর পূর্বে বাঙালি সাহিত্যমানস চেতনে অবচেতনে খণ্ডিত ভাবে, হিন্দু অথবা মুসলমান গোষ্ঠীসত্বার প্রতিনিধিস্থানীয়ই ছিল বললে, মোটেও ভুল বলা হয় না। আর বাংলার ইতিহাসে, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে এখানেই তাঁর অনন্যতা! বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী সম্মেলনে দেওয়া সভাপতির অভিভাষণে নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে চিরবিদ্রোহী কবি বলেছিলেন; “আমাকে কেবল মুসলমান বলে দেখবেন না। আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমান সকল জাতির উর্ধ্বে- যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তাঁরই দাস হয়ে”। ধর্মের উর্ধ্বে জাতিসত্বা, আর জাতিসত্বার উর্ধ্বে বিশ্বমানবতা! সেই বিশ্বমানবতার পথে এক অক্লান্ত পথিকেরই নাম, কাজী নজরুল ইসলাম। আর আমরা কি করলাম? তাঁর উত্তরসূরী না হয়ে, মানুষের সাথে মানুষের সহজ আনন্দের মিলনের পথে আবহমান কালব্যাপী বাধা সৃষ্টি করে আসা সেই ধর্ম নিয়েই আজও দুটুকরো হয়ে পড়ে আছি! আজও আমরা নিজেদেরকে হিন্দু মুসলমানেই বিভক্ত করে রেখে দি্য়েছিঁ কাঁটাতারের এপারে ওপারে! আর আজও সেই ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছি- রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে। ধর্মের আখড়াগুলকে পুষ্ট করে তুলছি, বিভেদ বিদ্বেষকেই রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার করে তুলতে! তাপরেও আমরা দাবি করব, আমরা নজরুলপ্রেমী বাঙালি? নজরুল আমাদের জাতীয় কবি? কিসের জোরে? তথাকথিত স্বাধীনতার নামে আত্মক্ষয়ী দেশভাগের পর প্রায় সাত দশক অতিক্রান্ত হলেও আজও হিন্দু হিন্দুই থেকে গেছে, মুসলমান থেকে গেছে মুসলমান, কেউই আর বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ আজ থেকে কত আগে, ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ছুঁৎমার্গ’ নামক প্রবন্ধে কবি জাতিভেদ প্রথাকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যার প্রধান কারণরূপে নির্দেশ করে বললেন, “হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান, শুধু একবার এই মহাগগনতলে সীমাহারা মুক্তির মাঠে দাঁড়াইয়া – মানব!- তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বল দেখি ‘আমার মানুষ ধর্ম’! দেখিবে দশদিকে সার্ব্বভৌমিক সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে!”
কবির সমগ্র জীবন ও সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই অবিভক্ত পরাধীন বাংলায় জন্মগ্রহণ করে, তিনি মূলত যে তিনটি বিষয়ে সুতীব্র বেদনাবোধে কষ্ট পেতেন ও দিনবদলের স্বপ্ন দেখতেন; সেগুলি হল- ১)বৃটিশের কাছে অন্যায় ভাবে পরাধীন থাকা- ২)হিন্দু মুসলমানের মধ্যে জাতপাতের বিভেদ বিদ্বেষজনিত কারণে সাম্প্রদায়িক দূরত্ব- ৩)অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নিপীড়িত মানুষের উপর মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক নিপীড়ন! আর মূলত এই তিনটি অভিশাপ থেকেই দেশ ও দশকে উদ্ধার করার অভিযানের তুর্যবাদকের কাজেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন কাজী নজরুল। বৃটিশের সাথে ক্ষমতা হস্তান্তরকে স্বাধীনতার নামে চালানোর পর ইতিহাসের জল অনেকদূর গড়ালেও প্রকৃত স্বাধীনতা আজও অধরা। হিন্দু মুসলমান আজও পৃথক দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক বিভেদের বীজ লালিত করে চলেছে সযত্নে। সাম্যবাদী কবির দেখা স্বপ্ন থেকে অনেক দূরবর্তী আজকের সমাজ অর্থনীতি। আর্থসামাজিক বিন্যাসে অর্থনৈতিক শোষনের ধারা পালটেছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত নিপীড়ন আজও অব্যাহত। বস্তুত কবি মানুষের মুক্তির যে স্বপ্নে বিভর হয়ে, তাঁর কলমে তুলে নিয়েছিলেন দিনবদলের গান, আজকের বিশ্ব তার থেকে অনেকটাই দূরবর্তী।
আর আমরা, অবিভক্ত বাংলার জাতপাত, ধর্মের নামে ভণ্ডামী, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আজও বহন করে চলেছি উত্তরাধিকার সূত্রে! যে মিলনের ডাক দিতে আবির্ভাব নজরুলের, সেই মিলনের পথে আমরা আন্তর্জাতিক সীমারেখা টেনে আজ বসিয়েছি কাঁটাতার! যার এক পারে বাঙালির পরিচয় ভারতীয় হিসেবে, অন্য পারে পরিচয় বাংলাদেশী বলে! বিশ্বমানচিত্রে বাঙালি আজ ব্রাত্য! দুই পারের মধ্যে সহজ মিলনের কোনো পথই আজ আর খোলা নেই, কাজী নজরুলের মাতৃভূমিতে। বাঙালি হিন্দু আর মুসলিম আজ আর ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ নয়, দুটি কাঁটা মাত্র! পরস্পর থেকে দূরবর্তী থাকার মধ্যেই তাদের অক্ষত থাকার চাবিকাঠি। এই কি চেয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি?
অনেক কাল আগে, ধুমকেতু পত্রিকার জন্মলগ্নেই, সেই প্রথম সংখ্যাতেই দ্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন কবি; “ ধুমকেতু কোন সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মনুষ্য ধর্ম সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দশ্য ”।
সেই উদ্দেশ্যের সাধক বিদ্রোহী কবির সাধনা আমরা একটি মাত্র দিনের জন্যেও কি আমাদের জীবনচর্চায় গ্রহণ করতে পেরেছি জাতি হিসেবে? না করতে চেয়েছি কোনোদিন? সত্যি করে বলতে কি, সেই প্রশ্নের মুখোমুখী হওয়ার মতো মানসিক জোরও আজ আর নেই আমাদের। তাই কবিকে নিয়ে যতই আড়ম্বর করি না কেন, তা না হয় সত্য, না হয় সম্মানের! বাঙালি, জাতি হিসেবে কবিকে যে ভাবে ব্যর্থ করেছে, এমনটি আর বিশ্ব ইতিহাসে আছে কিনা, সন্দেহ! উল্টোটা হলে বাংলাও ভাগ হতো না, স্বাধীনতার রঙও হতো সাম্যে ও মিলনে ভরপুর।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক স্নেহময় সিংহ রায় কবি সম্বন্ধে বলেছিলেন, “জগতের শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত মানুষ প্রচীন শৃঙ্খল শাস্ত্রসর্বস্বতা, আচারসর্বস্বতা ও কুসংস্কারান্ধতা থেকে মুক্তিলাভ করে শির উন্নত করে বিশ্বসংসারে আসন লাভ করুক, মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক- এই ছিল কবির আগামীকালের শোষণমুক্ত বিশ্বের মহত্তম স্বপ্ন”।
শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়ার ডাক দিয়েছিলেন কবি, এই বাংলার প্রান্তর থেকেই। মানুষে মানুষে মিলনের জয়শঙ্খ বাজিয়েছিলেন, আ-মরি বাংলাভাষাতেই। তাই জাতি হিসেবে তাঁর ভাবধারাকে অনুসরণ করে তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব ছিল আমাদের বাঙালিরই। সেই দায়ভার কি সত্যি কোনোদিন আমরা অস্বীকার করতে পারবো? ইতিহাস কি তাহলে আমাদেরকে ক্ষমা করবে কোনোদিন?
- বর্ধমান -
সুচিন্তিত মতামত দিন