সাঈদা মিমি








চৈত্রের দুপুর ঘুমায় না, আটাকলের ভিতরে আধাঘন্টা বসতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সঙ্গে মনের ব্যামো । হাতেম কে বলেছি আটার বস্তা বাসায় পৌঁছে দিতে । আমাকে একচক্কর যেতে হবে খেয়াঘাট, নদীতে কাল ভাসিয়েছি জোড়া পিদিম, মানত করেছি লাল গাইয়ের দুধ; বৈশাখের মান রেখো গুরু, নিশিকুটুম্বের হাতে শেষ সম্বলটুকু যেন না পড়ে! এসব কথা বলছিলো সামছু কাকা । একাত্তুরে তার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু জ্বিন খু ফু দানদানের প্যাঁচে পড়ে নাকি যুদ্ধেই যাওয়া আর হলো না । এসব আমার কথা নয় সামছু কাকার ভাষ্য । তার একটা বন্ধু জ্বিন আছে কিন্তু বহু বছর ধরে ঘোরাচ্ছে, গুপ্তধনের সন্ধান দিচ্ছে না । কেবল মানত আর মানত করিয়েই যাচ্ছে । এই গল্পটা এখানে থাকুক আমি বরং দেলার বাপের ঝুপড়ি থেকে ঘুরে আসি ।

দেলার বাপ ঘাটশ্রমিক,  অসম্ভব ফর্সা ও সুদর্শন । শ্রমিকদের মাঝে এমন দেখা যায় না, ফিল্মের হিরো হলে আলাদা কথা । সামছু কাকা দেলার বাপকে দেখলেই জিগায়, ‘ওই মদখোর, ইংরেজ কি তর মায়ের কাছে আইছেলে নাকি তর মায় ওম্মে গেছেলে?’ বলতে বলতে সামছু কাকা বকের মত গলা তুলে একধরনের অশ্লীল ঈঙ্গিত করে এবং দেলার বাপ ‘হালার পো’ হুংকার তুলে কাকার দিকে তেড়ে আসে । হাতে কখনও থাকে চেলাকাঠ কখনও অক্ষম আক্রোশের মুঠো । মুন্সিবাড়ির বর্ধিত অংশের বস্তিতে দেলারা থাকে, কোন এক কালে মেয়েটির নাম ছিলো দেলোয়ারা । দেলার বাপ এবং সামছু কাকা ঘোর শত্তুর, একটা জায়গা বাদে, জ্বিন পুত্র খু ফু দানদান ।

দেলার বাপ খু ফু দানদানের সাথে কিভাবে পরিচিত হলো! কাহিনীটা জানা গেলো দূর্গাপুজার সময়ে । এই অত্যন্ত সুদর্শন নিরীহ লোকটা সারাদিন ভুতের মত পরিশ্রম করতো, বেশ রাতে সে ফিরতো আকন্ঠ বাংলা মদ গিলে । ঘরে ফিরে আগে বৌকে পেটাতো, আণ্ডাবাচ্চা গুলোকে ঝালাই করতো এবং দেলাকে বেধড়ক গালমন্দ করতো বিয়ে হচ্ছে না এই অপরাধে । এমনি এক অষ্টমির রাতে দেলার বাপ হেলেদুলে ফিরছে । হঠাৎ মুন্সিবাড়ির ঘন বাঁশঝোপের নীচে আসতেই বিকট চীৎকার, ‘খাইয়া হালাইলে রে….’ ক্রমশ জড় হওয়া লোকগুলো দেখলো এক দৃশ্য বটে! দেলার বাপ সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসে কাঁপছে, লুঙ্গি মাথায় বাঁধা । চারপাশে কেমন যেন ভিজে! হতভাগা পেশাব করে তার মাঝে বসে আছে! রক্ষাকবচ ।বাঁশ ঝাঁড়ের মাথায় দুই পাশে দুই পা ছড়িয়ে নাকি এক হিন্দু ভুত দাঁড়িয়েছিলো , দেলার বাপের ঘাড় মটকানোর আগেই সে উলঙ্গ হয়ে হিসি করে দেয় । এই তুকতাকে ভুত পালিয়েছে ।

এটা হিঁদু ভুত তোকে কে বললো হতভাগা! ।হিন্দু ভুতেরা নাকি নগ্নতা আর পেশাব সহ্য করতে পারেনা! আর মোছলমান ভুত? উপস্থিত পাবলিক মজা করে জিজ্ঞেস করে । প্রসারিত হেসে দেলার বাপ বলে ওঠে, খু ফু দানদান মোর ইয়ার লাগে, মোরা একলগে মাল খাই । খু ফু! হয় সামছু মেয়ার জ্বিন, হ্যায় মোরে বড়লোক বানাইয়া দেবে! গল্পটা এখানে শেষ করা যাচ্ছে না কারন দুইটা কালো রঙের গলাছিলা মুরগি উৎসর্গ করার পর, জোড়াকবরের দীঘিতে পিদিম ভাসানোর পর, মাজারে করা মানত পুরা করার পর, শশ্মান ভস্ম জোগাড় করে মাটির নতুন হাঁড়িতে ভরে নেয়ার পরেও আসল কাজে হাত দেয়ার সাহস আর করতে পারে না সামছু কাকা । কিন্তু তার যে মোহরের হাঁড়িটা দরকার!

সব আয়োজন শেষ করার পর কি করতে হবে ফু খু তা বলে দিয়েছিলো । আশ্বিনের অমাবশ্যায় শশ্মানের মাঠে অপেক্ষা করতে হবে, সেখানেই আসবেন জ্বিন সম্রাট, দানবীয় কালো ষাঁড়ের আদল, মস্ত শিং বাগিয়ে । সেই ষাঁড়কে পরাস্ত করতে হবে, তার শিং ধরে শুইয়ে ফেলতে হবে সদ্য পোঁড়ানো কোন চিতাভস্মের ওপর । জিতলে মোহরের ঘড়া, হারলে শিংয়ের শুলে মৃত্যু । সামছু কাকা রোগা পটকা মানুষ, হাড় জিরজিরে । অনেক ভেবে সে হাত করলো দেলার বাপকে । এক বোতল সাবাড় করার পর দেলার বাপ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য ,অসুর জ্বিন সম্রাটের যোগ্য প্রতিদ্বন্দী ।

মহালগ্ন দরোজায় দাঁড়িয়ে, সেই রাতে দেলার বাপ আর ঋষিতুল্য সামছু কাকা কে গলা জড়াজড়ি করে শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

খু ফু দানদানের জন্মবৃত্তান্ত
(সামছু কাকার ভাষ্যমতে)

খু ফু দানদানের পিতা মহামান্য ছু ফু দানদানের জন্ম কোহকাফ নগরীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে| কিরছু রাজ্যের সম্রাট ফালাখ আলতাবির উজির ছিলো তার বাবা । নগরীর রাজসিক জাকজমকেও আনন্দ ছিলো না তার হৃদয়ে । কোহকাফের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতো সারাদিন । অদৃশ্য প্রহরী জ্বিনদের নজর এড়িয়ে কখনো চলে যেত নীল সাগরের গভীরে, মৎস রাজার প্রাসাদে । অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারার অপার্থিব ক্ষমতা আছে জ্বিনদের, ফলে ছু ফু দানদান কে কেউ দেখতে পেতো না । রাজ্যে নিরাভরণ সুন্দরী মৎস কন্যারা মাঝে মাঝে টের পেতো অজ্ঞাত কোন কারণে তাদের শরীর শিহরিত, অথচ আশে পাশে কেউ নেই! মৎস রাজের গ্রন্থাগারেই সে খুঁজে পেলো দূর্লভ এক কিতাব পার্থিব নারী ও কোহকাফি পুরুষ ।

মানবী ও জ্বিনের অমর এক প্রেমগাঁথা । বইটা পড়ে মগজ কেঁপে উঠলো ছু ফু দানদানের, সে মানবরাজ্য ভ্রমণের স্বিদ্ধান্ত নিলো । সাধারণ নাগরিক জ্বিনদের বিশ্বভ্রমণে কোন বাঁধা নেই বরং মানব সম্প্রদায়কে ত্যাক্ত করার জন্য জ্বিনরাজ তাদের উৎসাহিত করে থাকেন । সমস্যা হচ্ছে কুলীন জ্বিনদের নিয়ে, তাদের মানবনগরীতে যেতে কঠোর কিছু নিয়ম কানুন মানতে হয় । বহু শতক আগে কোহকাফি যুবরাজ খাফি মাহরাম দানুস এক আরব নারীর প্রেমে পড়ে রাজ্য পরিত্যাগ করেছিলো, বিয়ে করেছিলো আয়েশা জুলকারনাইন কে । বিপত্তির শুরু সেখানে, জ্বিনকুলে সহস্রায়ু অস্বাভাবিক নয় কিন্তু মানব গোষ্ঠীতে শতায়ু দূর্লভ । ষাটের কোঠায় পৌঁছুবার আগেই যখন প্রায় বৃদ্ধা আয়েশা মারা যায় তখন খাফি মাহরাফ যুবক । দীর্ঘ একাকীত্বের ভার বইতে না পেরে আত্মহত্যা করে খাফি, যা জ্বিনকুলের ইতিহাসে নেই ।

প্রাজ্ঞ এবং জ্ঞানপিপাসু জ্বিনেরা তাদের এই আয়ুকেও সামান্য মনে করে । এই ঘটনার পর অভিজাত জ্বিনদের মানব সংসর্গ নিষিদ্ধ করা হয়, কেবল জ্ঞানচর্চার জন্য তারা যেতে পারবে, বিশেষ কিছু নিয়মের অধীনে । সেই নিয়ম মেনে জ্ঞানসাধনায় বের হওয়ার জন্য পিতা রূহ জান দানদানের কাছে আর্জি পেশ করে ছু ফু দানদান । অনেক ঝক্কি ঝামেলার পর জ্বিন সম্রাটের অনুমতি মেলে, শর্ত দুটো: কোন মানব নারীর প্রেমে পড়া যাবে না এবং যে কোন মূল্যে তার জ্বিন পরিচয় গোপন রাখতে হবে, অন্যথায় কোহকাফে প্রত্যাবর্তন এবং কঠিন দণ্ড । এসব মেনে অলৌকিক ডানায় উড়লো ছু ফু দানদান ,পৌঁছুলো দক্ষিণ বাংলার এক অপূর্ব রাজ্যে । নদী ও ফসলের দেশে, সৌন্দর্য এবং প্লাবণের সমতলে । এক সৌম্যকান্তি যুবকের রূপ ধারণ করলো সে, মিশে গেলো মানব মানবীর স্রোতে, প্রথম মাসটা তার কাটলো নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে ।

মানব সম্প্রদায়ের রান্না মুখে তুলতে পারছিলো না সে, ব্যাতিক্রম কেবল হরেক স্বাদের মিস্টি । ছু ফু মিস্টির দিকে ঝুঁকে পড়লো এবং তিনবেলা মিস্টি চালিয়ে যেতে লাগলো । একদিন হোটেল মালিক বলেই ফেললো, 'হ্যা কা মেয়াবাই, আমনে দেহি জ্বিনেগো নাহান মিস্টি খায়েন!' সতর্ক হয়ে উঠলো ছু ফু দানদান| অতঃপর সে ভাত মাছ মাংস খেতে শিখলো । সর্বনাশ টা হলো দ্বিতীয় মাসে, সুন্দরী মেঘলীলা সিনেমা দেখে ফেরার পথে টক্কর লেগে গেলো ছু ফুর সাথে, মদনবানে আক্রান্ত হলো ছু ফু । এদিকে মেঘলীলার অবস্থাও সঙীন, মজে আছে সে ছু ফু দানদানের প্রেমে ।
অতঃপর বিয়ে হলো মেঘলীলা ও ছু ফু দানদানের । সে তখন সুবহান মালিক, পারস্য থেকে আগত ব্যাবসায়ী । ভালোই কাটছিলো দিন,  এরপর দ্বিতীয় বিপর্যয়টা ঘটলো,  মেঘলীলা তখন গর্ভবতী । জ্বিন জাতি যতই রূপ বদলাক, রাতের কোন এক প্রহরে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজস্ব শরীরে ফিরতে হয় তাদের । ভোর রাত, ঠিক ন মাস এগার দিনের গর্ভ থেকে নড়েচড়ে উঠলো শিশুটি । প্রসব বেদনায় কাতর মেঘলীলা স্বামীকে জাগাতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, বিশাল এক অজগর তার পাশে শুয়ে আছে!

ফেলো কড়ি লে যাও মাল
(দেলার বাপের ছেঁড়া ভাবনা)

পাক্কা আট পাইট মাল সাবাড় করার পর খু ফু দানদানের চেহারাটা স্পষ্ট হয় । এক্কেবারে দেবদূতের মত চেহারা, খালি মাথায় ছোট্ট দুইটা শিং আছে । দেলার বাপ তেড়ে আসে, 'হালার ভেউরা জ্বিন, মোর মোহরের ঘডি কোম্মে?' খু ফু ও সমান তেজে ফুঁসতে থাকে, 'যাইতে বলছি একলা দুইজনে গেছো কা? যাইতে বলছি চোখে সুরমা দিয়া আর শরীলে আতর মাখাইয়া, গেছো স্পিরিট খাইয়া! গোন্ধেই তো হে আয় নাই ।' খু ফু এখনও আঞ্চলিক উচ্চারণ রপ্ত করতে পারেনি । সে একজন সম্ভ্রান্ত জ্বিন, মানব রক্তের মিশেল থাকায় সে দ্বিগুণ শক্তিশালী । কষ্ট একটাই সে কোনদিন কোহকাফে যেতে পারবে না, ওখানে অনার্যদের প্রবেশ নিষেধ । দেলার বাপ তখন নয় নাম্বার পাইট গলায় ঢালতে ব্যাস্ত । এবার একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে খু ফু দানদান, 'আমার দয়ায় টাকা কয়ডা পাইছো সেইয়ার পাইন মারছিস?'
খু ফু’র কথায় আচানক টনক নড়ে ওঠে দেলার বাপের, আজ কড়কড়ে আট শ' টাকা দিয়েছে তাকে সর্দার । এই টাকাটা পাওয়ার কথা বিলাই বাচ্চুর, সর্দারের ডানহাত ব্যাডায় । কিন্তু বিলাই বাচ্চু কাল দপদপিয়া ফেরিঘাটে মারাত্মক একসিডেন্ট করেছে । গৌরনদি গিয়েছিলো শ্বশুর বাড়ীতে, ফিরতি পথে ফেরি পারাপার । সেই ফেরি ঘাটে ভেড়ার আগেই হিরোর মত তীরে লাফ দেয় সে, তারপর কোথায় কি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো জানা যায় নি । ডান পা পড়লো ফেরি আর পল্টুনের মাঝে, তখন খসর খসর ঘষা লেগে ফেরি ও ভিড়লো । মাঝে পড়ে বিলাই বাচ্চুর ডান পা ইন্নালিল্লাহে রাজেউন হয়ে গেলো । সকালে সর্দার তাকে ডেকে বললো, 'ওই হালা ইনরেজের পুত, আইজ গোনে তুই মোর ডাইনয়াত ।' তবে কি এ সবই খু ফু দানদানের দয়া! নিশ্চই সেটা হবে, নইলে বিলাই বাচ্চুর মত দড়াবাজ ফেরির তলায় পড়লো কেমনে? ভক্তিতে নুয়ে আসে দেলার বাপ ।
আনন্দ আত্মহারা দেলার বাপ গেলাসটা বাড়িয়ে দেয় খু ফু দানদানের দিকে । খু ফুর নীল চোখ জোড়া জ্বলতে থাকে, সে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে 'ফেলো কড়ি লে যাও মাল, বাচ্চে হো যাও গে লাল' এবং ভুস করে অদৃশ্য হয়ে যায় । কিঞ্চিত হতভম্ভ দেলার বাপ টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় । হাতে ঘাট বখরায় পাওয়া একজোড়া ইলিশ । বাঁশঝাড় পার হতে হতে সাবধান হয় সে, লুঙ্গিটা আগেই মাথায় পেঁচিয়ে ফেলে| বাড়ি পৌঁছেই দেলার মা কে মাছগুলি ভাজতে বলবে সে , বেতো গাড়লটা যেই মাত্র 'পারমু না' বলে বেঁকে বসবে অমনি চেলাকাঠ দিয়ে দূর্দান্ত এক পালিশ করে দেবে তাকে । নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ে দেলার বাপ, আর তখুনি খু ফু দানদানের শেষ কথাগুলি তার মনে পড়ে যায়, ফেলো কড়ি?
পরদিন রাতে দেলার বাপকে দেখা যায় বোতল হাতে জুয়ার আসর আলোকিত করে বসে আছে ।


খু ফু দানদানের মুক্তিলাভ
(সামছু কাকার স্মৃতি থেকে)


সামছু কাকা পীর বংশের ছেলে, পিতা ইবাদত গজনবির তৃতীয় পক্ষের প্রথম সন্তান সে । তার দাদাজান নাহিদ কুতুবি গজনবির পাঁচজন স্ত্রী এবং একজন অনুরক্ত জ্বিন রমণী ছিলো । দাদাজান যেদিন গোলাপ বজরায় করে দুর নদীর গভীর পথে যেতেন, সবাই জেনে যেত তিনি লাস্যময়ী জ্বিন সুন্দরীর সঙ্গে অভিসারে বের হয়েছেন । এই নাহিদ কুতুবির গোলাম ছিলো খু ফু দানদান । কুতুবিকে যমের মত ভয় পেতো দানদান, পান থেকে চুন খসলেই মন্ত্র পড়া সরষে, শুকনা মরিচ পুড়িয়ে নির্যাতন আর ধূপ ধুনোর সাথে হিং মিশ্রিত এক কেরামতি পাউডার ছুঁড়ে দিতেন, সারা দেহে ফোস্কা পড়ে যেতো খু ফু’র । সামছু কাকা এসব অনাচার দেখেও কিছু করতে পারতো না । আহা অসময়ের কত ফল এনে দিতো খু ফু, হরেক স্বাদের মিস্টি । একদিন বিদ্রোহ করলো খু ফু দানদান । সেদিন নাহিদ কুতুবির খায়েশ জেগেছিলো সে খু ফু’র পিঠে চড়ে নীল সাগরের হাওয়ায় উড়বে । এক সন্ধ্যায় আরব সাগরের ফেনা ছুঁয়ে গা ভাসালো খু ফু দানদান, পিঠে হুজুরে বোগদাদি নাহিদ কুতুবি ।

সেইকালে বঙ্গদেশ থেকে মানুষ আরব দেশে জাহাজে করেই বেশি যেত । ছ মাসের অধিক সময় লাগতো তাতে, কিন্তু খু ফু দানদান আতস; আগুনের তৈরি জ্বিনদের সোনালি রক্ত তার দেহে প্রবাহিত, সে মাত্র ছ মিনিটেই আরব সাগরে পৌঁছুতে সক্ষম তার অলৌকিক ক্ষিপ্রতার বলে । কিন্তু কাহিনী অন্য আরেক, আরব সাগরের মোহনীয় নির্জনতায় উড়তে উড়তে খু ফু’র নির্মম সব নির্যাতনের কথা মনে পড়তে শুরু করলো । পিঠে বসা কুতুবির প্রতি ঘৃণায় থরথর করে কেঁপে উঠলো তার শরীর, সে তার অবস্থান ভুলে এক ঝটকায় কুতুবিকে ফেলে দিলো পিঠ থেকে । সন্ত্রস্ত কুতুবি সাগরে পতিত হওয়ার আগেই খু ফু টের পেলো নীল কষ্টে বেঁকে যাচ্ছে তার দেহ, দাসত্বের শেকলে টান পড়েছে । সে বাধ্য হলো হাত প্রসারিত করে কুতুবিকে ধরে ফেলতে । কঠোর শাস্তিপ্রাপ্ত হলো খু ফু, বাড়ী পৌঁছেই খু ফুকে বোতলে বন্দি করলেন নাহিদ কুতুবি গজনবি । সেই রাতে সামছু কাকা দেখলো, একটা নিরীহ টিকটিকি ছিপি আঁটা বোতলের মধ্যে পাগলের মত ছটফট করছে, তার কিশোর মনে হাহাকার তৈরী হলো ।

সেই রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বোতলের মুখ খুলে দিলো সামছু কাকা| মৃতপ্রায় টিকটিকিটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে, ফ্যাকাসে । জ্বিনেরা তো শত সহস্র বছর বোতলবন্দি থাকতে পারে, খু ফু পারছে না কেন! হায় নিয়তি, এ যে তার মানবিয় লহুর দূর্বলতা! তার শ্বাসতন্ত্রে মানব ধমনির গঠন উপস্থিত । এবার খু ফু কে বাণমন্ত্র থেকে মুক্ত করার পালা, দাদাজানের কোকশাস্ত্র হাতে উঠানে পা রাখলো সামছু কাকা, হাতে হারিকেন । পাতাবাহারের ঝোপে বসে খুঁজলো আতিপাতি কিন্তু কিছুই তার মাথায় ঢুকলো না । বিমর্ষ সামছু কাকা ঘরে ফিরে এলো, সর্বনাশ খু ফু বোতলে নেই ! কিন্তু তার মন্ত্রবাণ কাটা হয়নি, যতদুরই যাক সে তো পালাতে পারবে না! আলগোছে বোতলের মুখ তুলে দিয়ে শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়ালো সামছু কাকা । চেহারায় একরাশ দুশ্চিন্তা ।

পরদিন দাদাজানের বিকট গর্জনে ঘুম ভাঙলো সামছু কাকার । এমনিতেই চিন্তায় তার সারারাত ঘুম হয়নি, ভোর রাতের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো , আচানক চিৎকারে তার মাথা পুরাই আউলে গেলো । সে বাসি মুখেই দৌড়ে এসে পড়লো কুতুবির পায়ের ওপর, হাউমাউ করে বলে উঠলো ,'আমি কিছু করিনাই দাদাজান ।' এই বায়াল চলতে চলতেই এক পশলা প্রহারের শিকার হলো সামছু কাকা । অনাহারি সকাল পার হলো, দুপুর ও । সে গোলাঘরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো । স্বপ্নে এলো খু ফু দানদান, বললো, 'নিশিন্দার তলে, মরা ডালখান ঝুলে, তার নিচে আত্মারাম, পুড়াইস তারে হইলে শাম ।' এ্যাঁ! ঘুম ভেঙে যায় কাকার । উঠেই দৌড় লাগায় সে পুবের ভিটায় । থোক থোক নিশিন্দা ঝোপের আড়ালে একটা চিমসে আকন্দের ধূসর কাণ্ড । ঘরের দিকে ছুট দেয় সামছু কাকা, একটা কোদাল দরকার, এক্ষুনি।

চলবে - |

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.