সাঈদা মিমি

ঢাকা থেকে ৩৫-৪০কি:মি: উত্তর দক্ষিণে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়াতে রয়েছে এক অনিন্দ্য সুন্দর জমিদার বাড়ি, ব্রিটিশ কলোনিয়াল আদলে গড়া উনিশ শতকে বাংলাদেশের অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি এটি। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত এই প্রাসাদ চত্বরটি প্রায় ১৬,৫৫৪ বর্গমিটার জমির উপর ছড়িয়ে থাকা ৭টি দক্ষিণমুখী দালানের সমাবেশ। এই দালানগুলো খ্রিষ্টীয় মধ্য ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতকের প্রথমভাগের বিভিন্ন সময়ে একটি স্থানীয় ধনী পরিবারের কয়েকজন সদস্যের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন গোবিন্দ রাম সাহা। তিনি মূলত খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকের শেষ দিকে একজন বর্ধিষ্ণু লবন ব্যবসায়ী ছিলেন। সামনের চারটি প্রসাদ ব্যবহৃত হত ব্যবসায়িক কাজে। এই প্রসাদের পেছনের প্রাসাদকে বলা হয় অন্দর মহল সেখানে বসবাস করতেন তারা।

বেশ উঁচু জমিদার বাড়ির ঢোকার মুখেই রয়েছে বিশাল দুটি সিংহদ্বার। সিংহদ্বার পেরোলেই খোলা চত্বর। তারপরই রয়েছে জমিদার বাড়ির মূল ভবন। জমিদার বাড়ির আঙিনায় রয়েছে ৪টি বিশাল ভবন, বন্দিশালা, গোলাঘর, রঙমহল, দরবার হল, অন্দর মহল। আরো আছে অন্দর মহলের শানবাঁধানো ৪ ঘাটলার দীঘি। আনুমানিক ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়।




শোনা যায়, জমিদার বাবুরা বেশির ভাগ সময়ই রঙমহলে কাটাতেন। রঙমহলে তারা সুর, শরাব আর নর্তকীদের নৃত্যের ঝংকারে মগ্ন থাকতেন।কালের সাক্ষী জমিদার বাড়িতে বর্তমানে রঙমহলের কক্ষটিতে শোভা পাচ্ছে জমিদারের ব্যবহার্য বিভিন্ন আসবাবপত্র। রঙমহলে রাখা কাচের আয়না ও শ্বেতপাথরের দুটি গাভি খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি কাড়ে।

৫ একর ৩২ শতাংশ কারুকার্য খচিত মনোমুগ্ধকর প্রতিটি ভবনের দেয়ালই জমিদারদের প্রতিষ্ঠা করা। জানা যায়, মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার বিনোদপুর ছিল বালিয়াটি জমিদারদের পূর্ব নিবাস। মহেশরাম সাহা নামে জনৈক বৈশ বরেন্দ্র শ্রেণীর ছোট্ট এক কিশোর নিতান্তই ভাগ্যের অন্বেষণে বালিয়াটি আসেন এবং জনৈক পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরি নেন। পরবর্তীতে ওই বাড়িরই মেয়ে বিয়ে করে শশুরের সঙ্গে ব্যবসা করে প্রথম শ্রেণীর ব্যবসায়ী হন। মহেশ রামের ছেলে গনেশ রাম লবণের ব্যবসা করে আরো উন্নতি লাভ করেন। গনেশ রামের ঘরে গোবিন্দ রামসহ ৪ ছেলে জন্মগ্রহণ করে। গোবিন্দ রাম বালিয়াটিতে বিয়ে করে এখানেই বসবাস শুরু করেন। গোবিন্দ রামের ৪ ছেলে প্রথমে একসঙ্গে এবং পরে পৃথক পৃথকভাবে ব্যবসা শুরু করেন। এই ৪ ভাই থেকেই বালিয়াটি গোলাবাড়ি, পূর্ববাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তরবাড়ি নামে ৫টি জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয়।

বালিয়াটির জমিদাররা শুধু ভোগ-বিলাসিতায় জীবন কাটাননি, তারা বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক ও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ঢাকার কেএম জুবিলি হাইস্কুল ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ছাত্রছাত্রী সংখ্যায় বৃহত্ আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বাড়ির জমিদার কিশোরিলাল শিক্ষা বিস্তারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে গেছেন। বংশানুক্রমে জমিদাররা বালিয়াটি হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিত্সালয় ও তত্কালীন ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে বালিয়াটিতে ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এছাড়া তারা অনেক মঠ ও মন্দির স্থাপন করে গেছেন, যেখানে আজও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজা আর্চনা করে থাকেন। তাদের অতীত কর্ম আজও দেশবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কালের পরিক্রমায় আজ আর বালিয়াটিতে জমিদারদের বংশের কেউ নেই। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ভগ্নদশায় বাড়িটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধীনে।

 

যাতায়াত : ঢাকা থেকে সাটুরিয়াগামী বাস যায় গাবতলী থেকে অথবা নিজস্ব গাড়িতে ধামরাইয়ের কালামপুর হয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টায় যাওয়া যায়।


 
- ঢাকা -

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.