ভোর থেকে একদণ্ড বিশ্রাম পায়নি রুমানা সকালের নাশ্তা তৈরি করে রুপমআর রুম্পাকে কে খাইয়ে রেডি করে স্কুল পাঠিয়ে সবে নিজে স্নান সেরে চুলে চিরুনি বুলাচ্ছে আর ভাবছে কি করে অফিস থেকে একফাকে বের হয়ে ওকে স্কুল থেকে তুলে নিয়ে বাসায় রেখে যাবে ,এসময় ও ফোন আসতে হয় ধরল মোবাইলটা ওপাশ থেকে তার কলিগ সম্পা বলল আজ সে অফিসে আসতে পারছে না রুমানা যেন একটু ম্যানেজ করে নেয় ,শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেল আজ তাকে স্কুল থেকে রুপমকে আনতে যেতেই হবে বুয়া ছুটিতে ড্রাইভারও ছুটিতে ,রুপমের বাবা ফরহাদ দেশের বাইরে গেছে পনেরো দিনের জন্য এসময়ই সবার ছুটির দরকার পড়লো ?একবার ভাবল ধুর! আজ অফিসেই যাব না যা হয় হক আবার ভাবল না যাওয়া উচিত অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও । অনেক চিন্তা ভাবনা করে রুমানা সিদ্ধান্ত নিল যাবে ,ঘরটা গুছিয়ে রাখল থালাবাসনগুলো ধুয়ে মাথায় একটা ক্লিপ দিয়ে ভেজা চুল আটকে নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হোল সে । রাস্তায় নামতেই আবার ফোন অচেনা নাম্বার দেখে ধরল না রিকশায় উঠে বসলো । অফিসে এসে ডুবে গেল কাজে ,অচেনা নাম্বারটা থেকে আবার ফোন এল এবার ও ধরল হ্যালো বলতেই চেনা কণ্ঠ শোনাগেল -
...কেমন আছো ?
......কে বলছেন প্লিজ ?
......আমি শফিক চিনতে পারনি ?অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা,ভুলে যাওয়া উচিত তোমার সব ।
চিনতে পেরেছে রুমানা প্রথমেই তবুও এককথায় বলে কি করে চিনি । একটা ভোতা আবেগ গলা টিপে ধরতে চাইছে ,গলার কাছে কি যেন আটকে আছে একি কান্না না ভয় ও ঠিক বুঝতে পারছেনা ।
......কি হল রুমানা চুপ কেন কথা বল কেমন চলছে সব ?
---ভাল আছি তুমি কবে দেশে এলে ?কি মনে করে ফোন করলে ?
---এসেছি একমাস হয়ে গেল তোমার নম্বরটা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল , ফোন করেছি রুপম কেমন আছ জানতে আর একটা জরুরী কথা ছিল সময় দিতে হবে আমাকে তোমার ।
---ভাল আছি সব ভাল চলছে এখন বল জরুরী কথাটা কি ? ।
---এভাবে বলা যায় না রুমানা সামনে এস এটা খুব জরুরী কথা একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার ।তুমি কবে সময় দেবে বল ?
---আমি এখন ব্যাস্ত ,সময় দিতে পারবো না বলেই লাইন কেটে দেয় রুমানা ।
ওর আর কাজে মন বসে না কেবলি অতীত সামনে এসে দাঁড়াতে থাকে কত কথা মনে পড়ে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে কখন একটা বেজে গেছে বাজে প্রায় এখনি স্কুল যেতে হবে । রূম্পা আর রুপম কে স্কুল থেকে তুলে কিছু খাবার কিনে বাসায় চলে আসে ও রুপম আর রুমানা খেয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে একটা গানই শুধু মনে পরে ;'' তোমায় গান শোনাবো ''ঘুমিয়ে গিয়েছিল ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আবার শফিক , কি চায় সে এতদিন পর ? ফোনটা ধরে ও ,বেশ কঠিন স্বরেই বলে ---কি বলবে বল ?
---শফিক, কিছু না একবার দেখা যে করতেই হবে তোমাকে ।
---না , কি হবে দেখা করে ? কেনই বা দেখা করবো বল ?
---তোমার বাঁ হাতের অনামিকায় এখনো আমার দেয়া আংটি ।কেন পরে আছো ? ভালোবাসো বলে ? না ফ্যাশন এ কথার উত্তর টা জানার জন্যই
তারপরই হেসে ওঠে শফিক বলে ওটা আসলে কোন কথা নয়, কথা হবে রুপমের বিষয়ে ।
---রুমানার বুকের ভেতরটা কেমন করতে থাকে , বলে কি বলতে চাও তুমি ?
---কি বলবো ওকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি ।
রুমানা আর কথা বলতে পারেনা লাইনাটা কেটে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রুমানা বুকের ভেতর একশো চিতার আগুন রুপম রুপম রুপম ,ওকে ছাড়া সে কি করে বাঁচবে ? আর সত্যিই ত কেন পরে আছে সে পরস্ত্রী হয়ে অন্যের দেয়া আংটি ? মনে পরে সেই কত বছর আগে এক জমকালো বিকেলে শফিকের মা এই আংটি টা ওর আঙ্গুলে পড়িয়ে দিয়েছিল সেই থেকে আছেই ওটা খোলার কথা কখনো মনেই হয়নি । যেন গভীর এক খাদের কিনারায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে রুমানা ,চিন্তায় দিশাহারা ।কখন যে সন্ধ্যা হয়েছে টের পায়নি , খেলা শেষে রুপম এসে ডাক দিতেই চমকে ওঠে সে , কিছু বুঝতে দেয়না ওদের , বিকেলের নাস্তা দিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পরে ।দুই ভাই বোন তখন পড়তে বসেছে।
রুপম ভাবছিল মাের কথা , মা কি আজ খুব অসুস্থ ? এত অস্থির কেন ? একবার ভাবল গিয়ে কাছে বসে পরক্ষনেই মত পাল্টালো সে ,ছোটবেলা থেকেই ও নিজের মধ্যে থাকতে ভালবাসে ওর যা একটু দুষ্টুমি রুম্পার সাথে আর সে ডুবে থাকে ছবি আঁকায় , খুব ছোটবেলায় বাবা ওদের নিয়ে দাদুর বাড়ি যেত,। মা যায়নি কোনোদিন আজ অব্দি । ফুপি ছাড়া এ বাড়িতে ও বাড়ির কেউ আসেনা ।তখন দেখেছে সব আদর রুম্পার ও অতিথির মত বাবার পাশে বসে থেকেছে শুধু , ও বুঝে গেছে ওদের পরিবারে কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি আছে ,সেই সাথে ও নিজেকে অনেককিছু থেকে দূরে রাখে আজো তাই সে মায়ের কাছে গেল না । মা খেতে ডাকছে ,খাওয়ার টেবিলেও মাকে খুব চিন্তিত মনে হল ,তবুও রুপম মাকে কিছুই জিজ্ঞেশ করল না ।
খওয়া শেষ ওরা শুয়ে পড়েছে। অনেক রাত বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে একটু জলজ হাওয়া ও বইছে রুমানা ভাবছে নাহ সমস্যা তাড়াতাড়ি সমাধান করে নেয়াই ভালো , ফরহাদ কে জানাতে হবে এখনি ।
ফোন ওকে পাওয়া গেল না হয়তো মিটিং এ আছে । অগত্যা নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে । ও শফিক কে ফোন করে সকালে ওর মায়ের বাসায় যেতে বলল ,শফিকও রাজী হল ।
বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সোজা রুমানা মার কাছে চলে এল । শফিক এলো ১০ ঠিক টায় ।কুশল বিনিময়ের পর আসল কথায় এলো সে '' আমি রুপম কে নিয়ে যেতে এসেছি ''
কিছুক্ষন রুমানা শুন্যে তাকিয়ে ছিল তারপর বলল ,কিসের জোরে ওকে তুমি নিয়ে যাবে ? ওর বাবা ফরহাদ ওর স্কুলেও ওর বাবার নাম ফরহাদ লিখা আছে রুপম ও তাই জানে । তাছাড়া এতদিন তুমি কোথায় ছিলে ? আজ দাবী করতে এসেছ রুপম তোমার ছেলে !
শফিক হাসল বলল তুমি দিশেহারা হয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছ; কোথায় কার নাম লেখা আছে তা দিয়ে কিছু প্রমান হয়না ,তুমি আমি ফরহাদ আরও অনেকেই জানে রুপমের বাবা কে ? কেন তর্ক করছ তুমি ?আমার ছেলে আমি নিয়ে যাব আমি থাকতে সে কেন অন্যের পরিচয়ে অন্যের বাসায় বড় হবে ?
---আমি ওকে দেব না
---কিসের অধিকারে তুমি দেবে না ?
---মায়ের অধিকারে দেব না ব্যাস ।
শফিক খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো বলল আমি আইনের আশ্রয় নেব । আর তুমি এতদিনের কথা বলছ ! তুমিই ত ওকে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছ গত দশটা বছর আমি তোমাদের ঠিকানা খুঁজে বেড়িয়েছি ,তুমি এ বাড়ির সবাইকে বলে দিয়েছ যেন আমাকে তোমার ঠিকানা না দেয়া হয় । কি হয়েছিল সেদিন আমাদের বাড়িতে আমি জানিনা আর তা আজ জানতেও চাই না ,যাই ঘটুক না কেন তুমি আমাকে না জানিয়ে এভাবে ঘর ছাড়লে কেন ? আমি বিদেশে তুমি কি করে পারলে বলত ? তারপর উকিল নোটিশ পাঠালে ডিভোর্স চাইলে , আমি তো বার বার তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলাম দেশেও এসেছিলাম তুমি দেখা করলেনা ,দুম করে বিয়ে করে বসলে ফরহাদ কে , করেছ তা তোমার ইচ্ছে হয়েছে করেছ ,এখন আমার ছেলেকে দিয়ে দাও ।
---যদি না দিই ?
---তা তুমি পারবে না ,শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায় ? এই দেখ হাসপাতালের ওর বার্থ সার্টিফিকেটে এখানে আমার নাম , সিজারের সময় বন্ড সাইন করেছি আমি । তুমি ওর ছয়মাস বয়সে কোলে নিয়ে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলে সেত সবাই জানে তাহলে আর কি প্রমাণ চাও তুমি ?
রুমানার মুখটা সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে হয়ে যায় ও বুঝে গেছে রুপমকে ধরে রাখা যাবে না ,আর আজকের পর থেকে ওখানেও তার পায়ের নিচে মাটিতে চির ধরেবে । ও শুধু বলল বেশ আমি রুপমের সাথে কথা বলি তারপর তোমাকে জানাবো এর মধ্যে ফরহাদ আসুক ।
---বেশ কথা বল আমিও বলব তবে এখানে ফরহাদের কোন ভুমিকা নেই কারন রুপম আমার সন্তান ।
রুমানা ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামে আর ভাবে ফরহাদের ভুমিকা আছে বইকি গত দশটা বছর ও ত বাবার অভাব কখনো বুঝতে দেয়নি রুপমকে । উদভ্রান্তের মত রুমানা হাঁটতে থাকে দুপুরের গোনগণে রোদে ।
- ঢাকা -
- ঢাকা -
ভীষণ স্পর্শ করলেন । কিছু লিখতে গিয়েও দলা পাকিয়ে আসে ক্রমসঃ । ভালো থাকুক রুপম । ভালো থাকুক রুপমের মতো শিশুদের যারা সত্যিকারের ভালোবাসে ।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন