"নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের জগতে
এক দুরন্ত ঝটিকা বেগ"
~ প্রেমেন্দ্র মিত্র ~
সত্যি বাংলাকাব্যে তিনি বয়ে এনেছিলেন কাল বৈশাখীর ঝড়। তাঁর কাব্যে ধ্বনিত হয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়ী যৌবনের জয়ধ্বনি।তাঁর কাব্য বীণায় ঝঙ্কৃত হয়েছিল "অগ্নিবীণার" সুর ঝঙ্কার।পরাধীন, জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে তিনিই তো সঞ্চারিত করেছিলেন নবযৌবনের শোনিতধারা।তাঁর কবিতায় ছিল নবভারতের সঞ্জীবনী মন্ত্র।সংগীতে ছিল সর্বহারার কান্নার বানী। তাঁর কবিতা ও সংগীতে সেদিন বিপুল আবেগে যৌবন জলতরঙ্গ নেচে উঠেছিল যেন "হিমালয় চাপা প্রাচী"।
কাজী নজরুল ইসলাম চির যৌবনের কবি।তিনি সেই যৌবনের ললাটে জয়টীকা এঁকেছেন, যে যৌবন শৃঙ্খলিত নিস্প্রান বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ।সেখানেই তিনি সোচ্চার, তিনি বিদ্রোহী।যে জীবন অনন্ত যৌবন আবেগে চির চঞ্চল,যার অফুরন্ত প্রাণ বেগে বহু বিচিত্র সৃষ্টি ওধ্বংসের মধ্যে ক্রিয়াশীল, তিনি সেই যৌবনেরই জয়গান গেয়েছেন।সেই যৌবনের জয়গানই কবির নিয়তি।
কবি যে যৌবনের বন্দনা করেছেন তার পথপ্রদর্শক হলেন ররবীন্দ্রনাথ। একদিকে সৃষ্টি সুখের প্রচন্ড উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে শিকলভাঙার আহ্বান---তাই "বিদ্রোহী" কবিতায় তিনি বললেন --
"আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস"
আমি দুর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার"
যৌবনের প্রচন্ড দুর্দমতার জোরেই তিনি বলতে পেরেছিলেন "বল বীর বল চির উন্নত মম শির" । "আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে " কবিতাটি তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর।
"মোর মুখ হাসে, মোর চোখ হাসে
মোর টগবগিয়ে খুন হাসে"।
"যৌবন জলতরঙ্গ" কবিতায় কবি গর্বোদ্ধতযৌবনকে বন্দনা করেছেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন - "যুগে যুগে ধরা করেছে শাসন গর্বোদ্ধত যে যৌবন "। "জীবন বন্দনা" মূলত যৌবনেরই কবিতা। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের দ্বারা লক্ষ কোটি বছরের নানা রূপ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নিত্য নব রূপে সাজিয়ে রেখেছে। শ্বাপদ সঙ্কুল ঊষর ধরিত্রীকে করেছে কুসুমিত মনোহরা কবি সেই সংগ্রামী মানুষদেরই জয়গান গেয়েছেন -
"বন্য শ্বাপদ সঙ্কুল জরা মৃত্যু ভীষণা ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহরা"।
"গাহি তারি গান" কবিতাতেও কবি জীবন শক্তির জয়গান গেয়েছেন। দেশের যুব শক্তির প্রতি কবি ছিলেন আস্থাশীল।স্বাধীনতা সংগ্রামে এই যৌবশক্তির অভিষেক করে তিনি বলেছেন -
"উর্দ্ধে গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণীতল
অরুণ প্রাকার তরুণ দল
চলরে চলরে চল্
চল্ চল্ চল্।"
কবি নজরুল সেই রক্ত লেখার কবি।ব্যথিত মানবাত্মার কবি।১৯৭৬ কালের ২৯শে আগস্ট বাংলাদেশের ঢাকা শহরে কবি দেহত্যাগ করেন।বিদ্রোহী কবি যৌবনের কপালে জয়তিলক এঁকে দিয়ে--দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার" উত্তরনের মরাত্রে দীক্ষিত করেছিলেন, কিন্তুতিনি পারেন নি বাংলাদেশের একগুঁয়েমির দূর্লঙ্ঘতা লঙ্ঘন করতে।সমগ্র বাঙালী জাতি নজরুলের কবি প্রতিভার কাছে ঋণী রইলো অসীম ঋণে। কবি অন্নদাশংকর রায় বলেছেন -
" ভূল হয়ে গেছে বিলকূল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি তো নজরুল।
এই ভূলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালী বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক। "
- রায়গঞ্জ / উত্তরদিনাজপুর - পশ্চিমবঙ্গ -
সুচিন্তিত মতামত দিন