
তাঁর এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরী , অন্য হাতে ছিল রণতূর্য। এমন আমরা আর দেখিনি।
বিশাল সিন্ধু, তার অসীম জলরাশি কোন সসীম পাত্রে ধারণ করা কী সম্ভব? ব্যাপক, বিস্তৃত অসীমকে কেবল তিনিই ধারণ করেছিলেন তাঁর ছোট্ট করপুটে এবং সেখান থেকেই মহা সিন্ধু গড়িয়েছিল তার লেখনি বেয়ে আমাদের চিত্তে--- তরঙ্গ বিভঙ্গে। ‘আহা !
“মরি মরি, সুন্দর সুন্দর!” “সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর! সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা, সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা, সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্ একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন!…
বাড়িয়ে বলিনি মোটে। শুধু জল কেন? সমুদ্রের প্রচন্ড গর্জন, প্রমত্ত উর্মিমালা সবই তিনি নিজের ভিতরে ধারণ করতে পেরেছিলেন—এমন আর কাউকে দেখিনি, কখনো দেখবোও না আমরা।
যিনি নিজের করপুটে ধারণ করেন আস্ত একটি সমুদ্র, তাঁকে, তাঁর বিশালত্ব পরিমাপ করার মতো কোন গজ ফিতে তৈরী হয়নি এখনো। নজরুলকে নিয়ে তাই যতোই বলা হবে ততোই কম বলা হবে।
অতি নিষ্টুর, দারিদ্রপীড়িত, অশিক্ষিত, বিবেচনাবোধহীন ধর্মান্ধ একটি সমাজের ভিতর থেকে এরকম বুক চিতানো দ্রোহের আগুণ নিয়ে দাউ দাঊ করে কবে কোথায় কোন কবি জ্বলে উঠেছেন? না—পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় জন নেই যিনি ভগবানের বুকে পদ চিহ্ন এঁকে দিয়ে এমনি বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিতে পারেন।
কী নেই তাঁর সিন্দুকে? প্রেম আছে, দ্রোহ আছে মাত্রাহীন, না পাওয়ার কষ্ট আছে, সীমাহীন রিক্তের বেদন আছে , সাম্যবাদের গান আছে---তেমনি আছে অন্ধত্ব ভাঙ্গার গান, পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গা গান। হ্যাঁ বলতেই হয়—হাতে পায়ে শেকল পরানো কোন কবি শেকল ভাঙ্গার গান এমনি করে এর আগে গায় নি—পরেও গাইবে না।
আসলে এতো সহজে নজরুলকে ধরে ধরে লিখে লিখে তুলে আনা সম্ভব নয়। নজরুল আকাশের মতোই অসীম, বিপুল। আমরা কেবল তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি—তাঁকে পরিমাপ করতে পারি না ---কেবল বুঝতে চেষ্টা করতে পারি তাঁকে তারই ভাষায়---যার ভয়ে হাবিয়া দোজখ, সপ্ত নরক নিভে নিভে যেতো কাঁপিয়া------
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন; আমি স্রষ্টা-সুদন; শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। আমি চির-বিদ্রোহী-বীর- আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!
- ঢাকা -
সুচিন্তিত মতামত দিন