আবু জাফর









“আমার পোষা টিয়ে”



ময়না ও টিয়ে পাখি যে পোষ’মানে এবং ওরা কথা বলতে পারে তা অনেক শুনেছি তবে এতদিন চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, মাঝে মাঝে মনে হতো একটা পাখি পোষার কথা, আবার মনে হতো অবোলা বনের পাখি স্বাধীন ভাবে উন্মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায় তাকে ধরে এনে খাঁচার ভিতর রেখে পোষা, এটা মনে হয় ঠিক না।
হঠাৎ একদিন একটি টিয়ে পাখি বাড়ীর উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় উঠানে পড়ে গেল, এবং হাটতে হাটতে ঘরের কোণায় পলানোর চেষ্টা করছে, ও বাচ্চা এখনো ভাল উড়তে পারেনা, তখন আমার ছেলে টিয়ের বাচ্চাটাকে ধরে রাখলো তা না হলে বিড়ালে ধরে মেরে ফেলতে পারে, তারপর বাজার থেকে একটি খাঁচা কিনে এনে তার ভিতর রাখা হলো। খুব আদর যত্ন করে ওরা যা খেতে ভালবাসে সেরকম ফল ও সব রকম খাবার দিয়ে পুষতে লাগলাম। এভাবে কিছুদিন যাবার পর ওর নাম রেখেছিলাম “মিঠু” আমি বাসায় যেয়েই ওকে নাম ধরে ডাকতাম মিঠু, একদিন দেখছি ওই বলছে মিঠু, আমি বলছি মিঠু কাকা ভাত খাবা ? ও আমাকে বলছে মিঠু, কাকা ভাত খাবা ? আমরা যা বলি ও তাই বলার চেষ্টা করছে।
তার পর একদিন মিঠুকে ছেড়ে দিলাম, খাচার বাহিরে খাবার দিয়ে দরজা খুলে দিলাম ও দিব্বি বেরিয়ে খেতে শুরু করলো, সন্ধ্যা হলে প্রথম দিন খাঁচার ভিতর ধরে তুলে দিলাম, পরদিন ছেড়ে দিলে ঘরের ভিতর বারান্দায় বেড়াতে লাগলো সন্ধ্যা হলে খাঁচার ভিতরে খাবার দিয়ে দরজা খুলে দিতেই ও খাঁচার ভিতর ঢুকে গেল। এ সময় মিঠুকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখে আমার ফেচবুক ওয়ালে দিলাম।
“আমার টিয়ে”
.................
আমার একটি টিয়ে আছে
নাম রেখেছি মিঠু,
দেখতে ও যতো ভালো
কথায় অনেক পটু।
কাকা আম্মা নিজের নাম
সব বলিতে পারে,
একবেলা না দেখিলে মোরে
অনেক ঝগড়া করে।
মাঝে মাঝে ছেড়ে দিলে
কোখাও নাহি যায়,
ঘুরে ঘুরে উড়ে এসে
বসে আমার গায়।
মিঠুর কথা শুনতে চাইলে
আমায় একটু বলেন,
ফেচবুকে ভিডিও আছে
প্লে করে দেখেন।।
এভাবে মিঠুকে  দির্ঘদিন ধরে ছেড়ে  দেয়া থাকে, কোথাও যায় না, ঘরের বরান্দার গ্রিলে আর পাশে মিন্দি (মেহেদি) গাছ আছে ওখানে বসে থাকে। মিঠু এখন উড়তে পারে, মাঝে মাঝে এঘর থেকে ওঘরে একটু উড়ে বেড়ায়। একটা পাত্রে খাবার দেয়া থাকে ওর ইচ্ছে মত খায়, আমি বাসায় খেতে গেলে অনেক সময় আমার থালায় খেতে লেগে যায়, রোজার মাসে ইফতারির সময় প্রায় আমাদের সাথে খেত। সন্ধ্যা হলে নিজেই খাঁচার ভিতর উঠে যায়।
একদিন বিকালে হঠাৎ করে উড়ে গেল! উড়ে যেয়ে বাড়ীর পাশে বড় মেহগনি গাছের উপরের ডালে যেয়ে বসলো, খোকার আম্মু তখন মিঠুর কাছেই সেলাই মেশিনের কাজ করছিল, ও দৌড়ে মিঠুর পিছে পিছে ওই গাছের নিচে গেল, ডাকতে থাকলো মিঠু নেমে আই... মিঠু নেমে আই... আর মিঠু, মিঠু উত্তর নিচ্ছে কিন্তু নামতে পারছে না। একটু পরেই বৃষ্টি নামলো সন্ধ্যাও হয়ে গেল, মিঠু এলো না। ওই দিন রাতে কারো ভাল ঘুম হয়নি, মিঠু গাছে বৃষ্টিতে ভিজছে, আর আমি চোখের জলে ভিজছি, সারা রাত মনে পড়ছিল ওর কথাগুলি, ও আমাকে কাকা বলে, আমি বাড়ী গেলে ও বলে কাকা... ও কাকা... ভাত খাবা...? পরের দিন ভোরে উঠে খোকার মা মেহগনি বাগানে যেয়ে দেখলো বৃষ্টিতে ভিজে নিচে পড়ে আছে কি না কিন্তু পেলো না, পরে আমি যেয়ে ডাক দিলাম মিঠু...? এবার ও উত্তর নিলো, অনেক ডাকাডাকির পরে সামনে আর এক গাছে উড়ে আসলো তবু নামলো না। 
এ ভাবে ৩দিন কেটে গেলো বাড়ীর আসে পাশেই থাকছে, ডাকলে উত্তর নিচ্ছে তবে নামতে পারছে না, ওর ডাকে আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে, হৃদয়ের কান্নায় বন্যা বয়ে যাচ্ছে, কাউকে বুঝতে দিচ্ছিনা  আমার বোবা কান্না, কারন বাড়ীর সবাই অস্থির, আমি নিজেকে বুঝ দেবার চেষ্টা করছি যে বনের পাখি যদি উন্মুক্ত খোলা আকাশে উড়ে বেড়াতে চায়, ক্ষতি কি ? আমার না হয় একটু কষ্টই হবে। আমার তখন এই কবিতাটি মনে পড়ে গেলো... 
কানাছ কোণে বাগান বনে পেলাম না তার ঘুরে,
শিকল কেটে ময়না আমার আজ গেছে হায় উড়ে।
হায়রে সাধের দুধকলা ভাত রইলো বাসন ভরা, 
ডাকলাম এতো ময়না আমার আর দিলনা ধরা। 
আদর করে খাওয়াতাম তারে নিজে গালে তুলে,
তবুও সাধের ময়না বুঝি আমায় গেলো ভুলে।
পরদিন আমি মটর সাইকেল বের করেছি যশোরে যাব বলে, যেইনা স্টার্ট দিয়েছি মিঠু শব্দ শুনেই ডাকতে ডাকতে ঘরের পাসে লিচু গাছে নেমে এলো, তার পর খাবার দেখিয়ে ডাকলাম ও ডাল বেয়ে হাচড় পাচড় করে নামার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, উড়তে গেলে দিশাহারা হয়ে আরো উপরের দিকে চলে যাচ্ছে। তখন চিন্তা করলাম ওকে নামিয়ে আনতে হবে। এবার ভুনা গোশদিয়ে ভাত মাখালাম, (ও মাখা হলুদ রঙের ভাত খুব পছন্দ করে) থালা ধরে দেখিয়ে ডাকলে ও ছোট আম গাছে নেমে এলো, আমি প্রাচিরের উপরে উঠে ওর একটু কাছে যেতেই ও চিকন ডালের আগায় এসে আমার থালার উপরে লাফ দিয়ে পড়লো এবং খাওয়া শুরু করলো, মনে হলো কতদিন খায়নি।
এ সময় পাড়ার লোক সব জড় হয়েছে, চারদিন ধরে টিয়ে পাখিটা গাছে গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে, সবার ধারনা ও আর আসবে না। মিঠু আমার হাতের থালাতে বসে ভাত খাচ্ছে আর আমি নিচে নামছি ওই অবস্থায় ওকে ঘরে নিয়ে গেলাম, তার পর ওর খাচার ভিতর খাবার রেখে খাঁচাটি সামনে ধরতেই ও আবার নিজের ইচ্ছায় খাচার ভিতর ঢুকে গেল। ভালবাসা পেলে বনের পাখিও আপন হয়।

ঢাকা। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.