কবিতার সাথে একদিন

আকাশ মেঘলা, তবু চারপাশে কেমন একটা গুমট বাতাস পাক খেয়ে যাচ্ছে । লোকটা একাই রতনবাবুর ঘাটের একধারে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। গাড়ির হর্ন আর রিকশার টুং-টাং এখানে একেবারেই ক্ষীণ।খালি শবদাহে আসা লোকেদের টুকটাক কথা আর অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারন, অর্থহীন শোকের বিলাপ, পাশের ঝাকড়া বটগাছের ওপর থেকে ভেসে আসা কাকের ডাক,নদীর কলকল শব্দ, সব কেমন যেন চলতে থাকা সিনেমার মত বহুবার দেখা দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে মন খারাপ ভাবটা আরও জাঁকিয়ে বসছে। লোকটার বউয়ের সাথে সাথে আরো অনেকেই বলে , ওর নাকি চণ্ডালের মতো রাগ। রহস্যজনক ভাবে দিন দিন ওর রাগ বাড়ছে অথচ চেপে রাখতে চাইছে বলেই হয়তো ভেতরের অস্থিরতা আরো বেড়েছে। কবিতা লিখতে খুব ভালোবাসে লোকটা। জীবনের সব না বলতে পারা কথা, না দেখাতে পারা রাগ, অভিমান, ভয়, শঙ্কা, কবিতা হয়ে কথা বলে। কিন্তু আজকাল সেই কবিতারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
শ্মশানঘাটে এসে কেন যে ও বসে আছে ঠিক মনে পড়ছে না, বা হয়ত লোকটাই মনে করতে চাইছে না। আসলে কেউ কি জানে একেকটি মানুষ বুকের মাঝে কি গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায় ! লোকটা এই মন হু হু করা এই ব্যাকুল বিরহের নাম জানে না। আসলে ওর মনটাকে হয়ত কবিতা ছাড়া কেউ জানে না, বোঝেনা। তাই কবিতাকে হারিয়ে মানসিক বিপন্নতায় ভরা এই সময়টা বড্ড ঝাপসা।এবেলায় এখনও একবারও এলোপাথাড়ি ভাবনারা আসেনি কেউ।মাথার ভেতরে কেমন খালিখালি লাগছে। ভাবার মত, কল্পনা করার মত, কিচ্ছুটি আর নেই সেখানে। বেবাক শূণ্য। ভাবার সাথে সাথেই তার ভেতরের ঘাপটি মারা শুন্যতাটা ছটফটে পায়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো। নাহ!!!!...বলে উঠে দাঁড়াল লোকটা। মেঘলা দুপুরগুলোয় এমনিতেই অবসাদ তীব্র হয় ওর।মনে হয় বেঁচে থাকার মত নিরর্থক আর দুর্বিষহ একঘেয়েমি বুঝি আর কিছু নেই ।
সুতরাং বেঁচে থাকা নামক অসহনীয় কার্যের একটা তাৎক্ষণিক সমাপ্তি আজই চাই।সিদ্ধান্তটা নিয়ে একই সাথে অস্থির আর খুশীখুশী বোধ করল সে।আজ জীবনের সাথে একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাক। কিন্তু আত্মহত্যারও কিছু নিয়ম আছে । সে অনুযায়ী প্রথমেই লিখে ফেলতে হবে একটা সুইসাইড নোট।তবে তার জন্য চাই কাগজ আর কলম। বুকপকেটে কলম তো আছে কিন্তু কাগজ? পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢোকাতে একটা ১০ টাকার নোট উঠে এল। টাকার ওপর সুইসাইড নোট? আইডিয়া মন্দ নয়।আপনমনেই হেসে ফেলল লোকটা।
সাথে সাথেই সময় থেকে এক টুকরো অপার্থিব মুহূর্ত ভেঙ্গে এনে ওর মনের মধ্য গুনগুনিয়ে একটা কবিতা ভেসে এল -
“ আমার দীর্ঘ একটা জীবন
হয়ত একশ’ কি হাজার বছরের ,
দিন যদি আরো লম্বা হত, চিন্তার সুতোর মত,
রাত্রি যদি আমার নিদ্রার মত দীর্ঘস্থায়ী হত,
তাহলে হয়ত বা জীবনকাব্যের
প্রতি বাক্যের, প্রতি শব্দের
পল – অনুপল বুঝতে পারতাম
এতো করে চাই একটা দীর্ঘজীবন,
তবুও কেন যে আমার রাত্রিদিন বয়ে চলে
ঝিরঝির হাওয়ার মত,
ঝরঝর ঝর্ণাধারার মত।
একলা আমি বেলা পড়ে এলে
উদাস দার্শনিক সেজে ভাবি,
জীবন এতো ছোট কেনো ! ”
কবিতাটা মনে আসতেই মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। একটা বাঁধনছেঁড়া আনন্দ মন থেকে মন খারাপের মেঘটাকে যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। আত্মহত্যার চিন্তাটাও বেমালুম ভুলে গেল সে।হাতে ধরা দশটাকার নোটটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো এক কাপ চা পেলে মন্দ হত না।শ্মশানঘাটের গেটের বাইরে একটা চায়ের দোকান ঢোকার সময়েই নজরে পড়েছিল। সেদিকেই পা বাড়ালো লোকটা।ছোট্ট এইটুকু এক ভাঁড় চা ৫ টাকা। শালারা শ্মশানঘাটেও ব্যবসা ফেঁদেছে। মাছি ভনভন টেবিলটা মুছে দিতে বলায় বছর দশেকের চোখে পিঁচুটিপড়া একটা বাচ্চা ছেলে একটা ভেজা ন্যাতা হাতে উবু হয়ে টেবিল টা মুছতে লাগলো। খালি গা, কারুর দয়ার দান মলিন রং জ্বলা প্যান্টটা কোমরে কোনমতে আটকে আছে নারকেল দড়ি বাঁধা অবস্থায়, বাকি সব বেশ উদার খোলা মেলা।এই বয়সী একটা মেয়ে আছে লোকটার। বড় বাপ ন্যাওটা মেয়ে। মেয়ের কথায় বাড়ী ফেরত যাবার একটা তীব্র টান টের পায়।ইস এত বেলা হল! মেয়েটা মর্নিংস্কুল থেকে ফিরে স্নানটান সেরে না খেয়ে বসে আছে হয়ত বাপের জন্য। চায়ের দাম মেটাতে পকেটে হাত দিল, ৫ টাকার ফিরতি কয়েন ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো, এই নে রাখ।মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল, ছেলেটার চোখে একটা যেন খুশীর ঝিলিক দেখে মনটা আরেকটু ভালো হয়ে গেল। ঠিক তখনই কে যেন পিছন থেকে পিঠে হাত রাখলো,
- আরে তুই এখানে? আমি আবার গঙ্গার ঘাটটাট সব খুঁজে এলাম।নরেনদার দাহকাজ শেষ। এবার চল বাড়ী ফিরতে হবে। লোকটা বন্ধুর সাথে হাঁটা দিল অপেক্ষমান ম্যাটাডোরটার দিকে।
কলকাতা ।
caliye jao ...onek bhalo hoyeche ...mou ...
উত্তরমুছুননিজের সাথে একা -
উত্তরমুছুনভাল লেখা আপনার বন্ধু পড়ে ভাল লাগে একার গল্প।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন