কাব্যের আলোয় জীবনানন্দ
আমি কবি- সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল- মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন কামনা জাগিছে প্রাণে !
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন কাজরীর গানে !
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন- দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি !
-- জীবনানন্দ দাশ --
জীবনানন্দ দাশ, তিনি আমার কবি, আমাদের কবি। বিশ শতকের শেষভাগে এসে প্রায় প্রত্যেক বাঙালী সমালোচকই কবি জীবনানন্দকে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে শক্তিমান কবি হিসেবে কোন ভাবে না কোনভাবে উল্লেখ করেছেন। বাণী রায় জীবনানন্দকে বলেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার জনক’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার আবির্ভাবকাল বলা হয় দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকুকে মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের জেলাশহর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে সমাদৃত ছিলেন।জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন কবি, তাঁর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণীর পাঠ্য। জীবনানন্দ(ডাকনাম ছিল মিলু) ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান।
কবির কাব্যচর্চার সুত্রপাত অল্প বয়স থেকেই। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ আবাহন। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি, কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে পত্রিকার বর্ষশেষের নির্ঘণ্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়: শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তার প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেই তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোলপত্রিকায় 'নীলিমা' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যসরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যার মধ্যে রয়েছে সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই তিনি তার উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।সে সময়কার প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস| শনিবারের চিঠি পত্রিকায় তার রচনার নির্দয় সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তার ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাথে সাথে তা কলকাতার সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি তার বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন;- তবে তার জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত করেন নি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন যা পরবর্তীতে তার রূপসী বাংলা কাব্যের প্রধান অংশ নির্মাণ করে। জীবনানন্দ এ কবিতাগুলো প্রকাশ করেননি এবং তার মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ সালে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগন্থ “ধুসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)” থেকেই কবির স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পেতে থাকে। এরপর “বনলতা সেন(১৯৪২)”, “মহাপৃথিবী (১৯৪৪)”, “সাতটি তারার তিমির(১৯৪৮)” প্রকাশ পায়। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে তিনি দু'টি উপন্যাস লিখেছিলেন - মাল্যবান ও সুতীর্থ, তবে আগেরগুলোর মতো ও দুটিও প্রকাশ করেননি। এ বছরেই তিনি 'সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র' নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫২ খৃস্টাব্দে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। ১৯৫৪ খৃস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। বইটি ১৯৫৫ খৃস্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।কবির জীবদ্দশায় আর কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়নি। কবির মৃত্যুর পরে “রূপসী বাংলা(১৯৫৭, খসরায় কবি স্বয়ং নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা )”, “বেলা অবেলা কালবেলা(১৯৬১)”, “মনবিহঙ্গম(১৩৮৬ বঙ্গাব্দ)”, “আলোপৃথিবী(১৩৮৮ বঙ্গাব্দ)”, এবং “হে প্রেম, তোমারে ভেবে ভেবে(১৯৯৮)” এ প্রকাশ পায়। প্রাবন্ধিক জীবনানন্দের প্রবন্ধ “কবিতার কথা” ও প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পরে ১৩৬২ বঙ্গাব্দে।
বুদ্ধদেব বসু একসময় ‘জীবনানন্দ তার কবিতার জন্য নিজস্ব শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নিয়েছেন’ বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জীবনানন্দের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে লিখেন,
- ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দের আগে কোন বাঙালি কবিই কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ এবং ইংরেজি শব্দের এত বিস্তৃত, স্বচ্ছন্দ এবং যৌক্তিক ব্যবহার করেন নি। এ সব উদাহরণ (জীবনানন্দের কবিতা থেকে) নিজেদের রচনা সম্পর্কে আমাদের আরো সাহসী হতে অনুপ্রাণিত করে’। (কবিতা পত্রিকা, পৌষ-১৩৬১ বঙ্গাব্দ)‘।
- জীবনানন্দের কাব্যভাষা নিশ্চিতভাবেই বাংলা কবিতার সাধারণ কাব্যভাষা নয়, এমনকি এটা তার মুখের ভাষাও নয়’। (একটি নক্ষত্র আসে- অম্বুজ বসু)।
- শরৎ কুমার এর মতে জীবনানন্দ দাশ ইচ্ছাকৃতভাবে সাধু ভাষার সাথে চলিত ভাষা মিশিয়ে এক ধরণের অস্বস্তি সৃষ্টি করতেন। অনেকটা পরিহাসের ভঙ্গিতে তিনি যোগ করেন, ‘এটা আমাদের মহানুভবতা যে যখন আমরা পড়ি, এ ব্যাপারটা আমরা মেনে নেই, তার বর্ণনাভঙ্গির প্রতি কোন বিরূপভাব আমরা পোষণ করি না। কিন্তু আমাকে বলতেই হয় যে এই মিশ্রণ এখন কবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে’। তার ভাষায়, ‘সত্যিই কি সাধু এবং চলিতের মিশ্রণ কোন বাক্যকে খুব শ্রুতিকটু করে তোলে? কিন্তু একমাত্র জীবনানন্দ ছাড়া আমরা আর কারো কাছ থেকে এই মিশ্রণ মেনে নেই নি, এটা তার সাফল্য যে তিনি আমাদের কাছ থেকে তা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। জীবনানন্দ সময়ে সময়ে মাত্রাবিন্যাস মানেন নি, ক্রিয়াপদ ব্যবহারে তিনি প্রায়ই ভুল করেছেন যেমন ছড়াতেছে (এটি সাধুও নয়, চলিতও নয়), তিনি কিছু অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করে যেমন ভাঁড়, গাঁট, হাইড্র্যান্ট, বেফাঁস পাঠককে বিপদে ফেলেছেন। পাঠকের বিরক্তি শেষ হতে না হতে তিনি তাকে নিয়ে যান প্রসঙ্গান্তরে’।
সজনীকান্তের মতো কিছু পাঠক কবির শব্দ ব্যবহারের এই খামখেয়ালীপনায় কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তা আমরা আগেই বলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, কবির জীবদ্দশায় গুণগ্রাহীদের সংখ্যা ছিল অল্প। বরং নানান দিক থেকে তাঁর কবিতা সম্পর্কে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ এবং সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিলো। কিন্তু পরের দিকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং জীবনানন্দ পান রবীন্দ্রোত্তরকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির সম্মান। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জীবনানন্দ দাশের প্রথম স্বীকৃতিদাতা। তাঁর একটি চিঠিতে পাই-
“তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই।–কিন্তু ভাষা প্রকৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।”
জীবনানন্দ দাশ সত্যিকার অর্থে একজন আধুনিক কাব্যস্রষ্টা ছিলেন। এবং তিনি সফল প্রয়োগ করেছিলেন ‘আধুনিকতাবাদ’-কে তাঁর কবিতায়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- এ সকল কবিতা যে ভাবাদর্শ থেকে উৎসারিত, তা তাঁর মৌলিক চেতনালব্ধ নয়।
(১) ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মৃত্যুর আগে’-র সাথে জন কিটসের ‘Ode to Autumn’ কবিতার সাদৃশ্য লক্ষনীয়,
(২)‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ ‘কাক ও কোকিল’এর সাথে কবি কিটসের ‘Ode to a Nightingale’ এও নাইটিংগেল পাখির অসম্ভব মিল।
(৩)‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জীবনানন্দ দাশ বলতেই যে কবিতাটি আমাদের মস্তিষ্কে অনুরণিত হয়, তা হল- ‘বনলতা সেন’:আর আজকের সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন কবিতার িভিন্ন অংশে অ্যাডগার অ্যালেন পো এর Helen,(Thy hyacinth hair, the classic face.), জন কিটসের On First Looking into Chapman’s Homer ,এবং ইয়েটস্ এর ‘He Reproves the curlew’ এর যথার্থ মিল রয়েছে।
(৪) ‘আট বছর আগের একদিন’ এ কবি যেমন সরাসরি মৃত্যুকে এনেছেন তা কবি শেলীর Ode de the West Wind কবিতার সাথে তুলনীয়।
১৯৪৪ সালে জীবনানন্দ দাশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ কবিতার নায়ক, যিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ, এক দীর্ঘ দুঃসহ ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে। মূলত এ থেকে প্রতিভাত হয় ঐ সময়ের মানুষের জীবনের পীড়ন এবং যন্ত্রনাময় প্রতিবেশের গণ্ডি পেরোনোর চিত্রকল্প। কবিতাটির এ অংশ উল্লেখ্য-
জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
সম্ভবত জীবনানন্দীয় কাব্যে প্রথমবারের মতো বৃহৎ আকারে ‘আত্মহত্যা’ স্থান করে নেয়। এক্ষেত্রে উক্ত কবিতা সম্পর্কে জ্যোতির্ময় দত্তের মন্তব্য স্মরনীয়:“ভাবতে অবাক লাগে জীবনানন্দের আগে বাংলা কবিতায় আত্মহত্যা প্রবেশ করে নি। স্থির বিশ্বাসে আত্মদানের নিদর্শন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য আছে। কিন্তু আত্মহত্যার উদাহরণ নেই। এবং ইউরোপীয় সাহিত্যেও অকারণ আত্মহত্যা নতুন। জীবনানন্দের আগে সেই ধারনা কি কোনো ভারতীয় আহ্বান করে নি ? দস্তয়ভস্কির আগে কোনো ইউরোপীয়কে ?
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই অক্টোবর সন্ধ্যার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন কবি। তাঁকে ভরতি করানো হয় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ২২শে অক্টোবর সন্ধ্যায় কবি এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ-সহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন হয় আত্মহত্যা স্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা মূলত প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের জন্য। বাস্তব আর অবাস্তবের লীলাখেলায় মত্ত জীবনানন্দের কবিতার অর্থ আমাদের কাছে আলো আঁধারির খেলা করে।তাঁর লেখুনির রহস্যময়তা, বিস্ময়বোধ, আমাদের মতো ক্ষুদ্র পাঠককে ভারাকান্ত করে, আপ্লুত করে, কোন এক গভীর অতলান্তে নিমজ্জন করে। কবি রোমান্টিক ছিলেন, প্রতীকী কবি ছিলেন । তার কবিতা রূপময়, ধ্বনিময়, চিত্রময় । এক্ষেত্রে তিনি একজন আধুনিক চিত্রশিল্পী । সুনির্বাচন, চমৎকার শব্দের ভিন্ন ব্যতিক্রমী অর্থব্যাঞ্জনাময় মনোরম চিত্রসম্বলিত হয়েই জীবনানন্দের কবিতা উপস্থাপিত ।
তাঁর কবিতায় স্যুররিয়াল্যাজমের অত্যন্ত সার্থক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় বলেই সমালোচকদের অভিমত । তিনি সময় ও ইতিহাসকে করেছেন বস্তু বিচারের মানদণ্ড । নারী, প্রেম, প্রকৃতি জীবনের চরিতার্থতা সব কিছুই ইতিহাসের কাললগ্ন, তারা সময়ের সমস্ত দহনে দগ্ধ নারী-পুরুষের উপলব্ধির মধ্য দিয়েই ঐকান্তিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর ইতিহাস সচেতনতা সম্পর্কে বলতে হলে তাঁকে বলতে হয় ইতিহাসের তিনি এক ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক ।
কবি প্রচলিত ছন্দের বাইরেও নিজস্ব ভঙ্গিতে, নিজস্ব সুর, ভাষা ও ভাবনায় বক্তব্যকে উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কাব্যে শুধু প্রেম প্রকৃতিই যে আছে তা নয়, ইতিহাস, মৃত্যুচিন্তা, নির্জনতা, রাত্রি অন্ধকার, নক্ষত্র , প্রবাদ, পুরাণ কথা, দেশজ ঐতিহ্য, আধুনিক আর্থ-সামাজিক আস্থা সমষ্টি, মানুষের বেদনা, রাষ্ট্র, জীবনব্যবস্থা, চেতন অবচেতনে নানা রকমের বোধের বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। ধূসর পাণ্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থে সংবেদ বা ইন্দ্রিয়প্রবন এর সহযাত্রী হয়েছে বনলতা সেন । আবার মহা পৃথিবী ও সাতটি তারার তিমির –এ প্রাধান্য পেয়েছে সময় । রূপসী বাংলাতে প্রাধান্য পেয়েছে নিসর্গ প্রকৃতির অসাধারণ চিত্র। যদিও প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জীবনানন্দ দাশ ছিলেন চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর মতই কোমল এবং শান্ত, কিন্তু কিছুক্ষেত্রে তাঁর কবিতাতেও সমসাময়িক রাজনীতিক প্রতিবেশের কঠোর প্রতিবাদ ফুঁটে উঠেছে-
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে, ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোসলেম বিনা ভারত বিকল, বিফল হিন্দু বিনা;
-মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান।
(‘হিন্দু-মুসলমান’, বঙ্গবাণী)
এটি ১৯২৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রতিবাদে লেখা। আবার ১৯৪৬-৪৭ সালেও একই বিষয়ে তিনি পুর্বাশা পত্রিকায় আরেকটি কবিতা প্রকাশ করেন:
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ-
আর তুমি ?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে-রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, ‘গগণ, বিপিন, শশী পাথুরঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রীটের, এন্টালির-’
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব;…
ভাষার দক্ষ ব্যবহার, তীব্রবোধগ্রস্ত চিত্রকল্প, ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রবল প্রকাশ, বিপুল অনিশ্চয়তা এবং ততোধিক বিপুল অনিরাপত্তার বিশ্লেষণধর্মী অনুসন্ধান- এসব মিলিয়েই জীবনানন্দের সৃষ্টি এবং এসবই জীবনানন্দের কাব্যের শক্তি। জীবনানন্দের সমসাময়িক এবং পরবর্তী যুগের কবিরা যখন তার কবিতায় ভাষার নবতর প্রয়োগ এবং আবহমান বাংলার চিরন্তন প্রকৃতির ভাষিক প্রকাশের কথা বলেন তখন তা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাইরের পৃথিবীতে জীবনানন্দকে ততটা স্পষ্ট করে তুলে ধরে না। বরং নৈরাশ্যবাদী, নিঃসঙ্গ, এবং প্রকৃতিতে আত্মমগ্ন বিশেষণেই জীবনানন্দকে বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারা যায়। কবি নিজে লিখেছিলেন, ‘কবিতা-সৃষ্টি এবং কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমনের ব্যাপার’।
জীবনানন্দের কাব্য শেষ পর্যন্ত একজন সাধারণ মানুষের সুক্ষ্ম অনুভবের তীব্র প্রকাশ, ভাষার ব্যবধান তুচ্ছ করে পুরো পৃথিবীকে যার অনেক কিছু বলার আছে। জনতার কোলাহল থেকে দূরে সরে থাকা এই সাদাসিধে মানুষটি বরাবরই কবি ছিলেন; তিনি বিচ্ছিন্নতার কবি। তিনি নিজেই বলেছিলেন-
“সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।”
সম্ভবত এজন্য, জীবনানন্দ দাশ; সকলের কবি নন, কারো কারো কবি।
কলকাতা ।
সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি । সুন্দর উপস্থাপনা ।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন