"ব্রাত্যজনের রবীন্দ্রনাথ"

গীতাঞ্জলির অস্তিত্ব বিরহের কবি তাঁর জীবনদেবতার প্রেরণায় বিশ্বদেবতার পায়ে নিজের অন্তরসত্ত্বার নৈবেদ্যে
যতই স্নিগ্ধ হয়ে ওঠেন ততই তিনি আধ্যাত্মিকতার পথে এগিয়ে চলেন পরিপূর্ণ মানবতার বাস্তব ঠিকানায়!
ঠিক এই কারণেই কবি বলেলেন, "দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে/ নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে!" নিজেকে নিরন্তর বিশুদ্ধ করে না নিলে পৌঁছানো যায় না পূর্ণ মানবতার ঠিকানায়! রবীন্দ্রজীবনে গীতাঞ্জলি পর্ব সেই বিশুদ্ধ করে নেবার আন্তরিক সাধানার ঐকান্তিক প্রয়াস! সাধারণ ভাবে আমাদের ভুল হয়ে যায় অধিকাংশ সময়ে, কবির অভিপ্রায় সম্বন্ধেই!
ভাবি নিরালা নির্জনের সাধক রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার বলয়ে আপন ব্যাক্তিত্বেই মোহিত কবি!
না; নিজের আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতায় মোহিত থাকার মানুষ তো ছিলেন না কবি! মানুষের যে দুঃখ যে অপরিপূর্ণতা যে সীমাহীন বঞ্চনার অভিশপ্ত জীবনের নিদারুণ কঠোর বাস্তবতা তিনহাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছিল; সেই একই বিচারের বাণীর নিরব নিভৃত ক্রন্দন উদ্বুদ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে, আপন ব্যাক্তিসত্ত্বার নিগূঢ় অহংকে সমর্পণ করে বিশ্বমানবের বেদীতে তাঁর শ্রেষ্ঠ অঞ্জলি নিবেদন করে যেতে! ঠিক সেই কারণেই গীতাঞ্জলি পর্ব . ব্যাক্তি রবীন্দ্রনাথের বোধিবৃক্ষ পর্বেরই নামান্তর মাত্র! তাই গীতাঞ্জলির রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী রবীন্দ্রনাথ থেকে বিচ্ছিন্ন নন! পরবর্তী প্রবাহে পৌঁছানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঁক!
অনেক রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন প্রবাহে গীতাঞ্জলি পর্বের এই ভূমিকার বিষয়টি সম্বন্ধে উদাসীন! ফলে সাধারণ ভাবে অনেকেই মনে করেন গীতাঞ্জলি পর্বের রবীন্দ্রনাথ; জীবনের শেষপর্বের রবীন্দ্রনাথের থেকে ভিন্ন মাত্রার! কিন্তু তাই কি? অনেকে এও মনে করেন রাশিয়া ভ্রমণ কবির জীবনে এক অন্যতম পর্বান্তর! রাশিয়া ভ্রমণ কবিকে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করেছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু রাশিয়া ভ্রমণ কবির ধ্যানধারণায় বিশেষ কোনো ওলোট পালট ঘটায়নি! ঘটায়নি কারণ রাশিয়া যাওয়ার অনেক আগেই, রুশ বিপ্লবের আগেও গীতাঞ্জলি পর্বে ১৩১৭ এর ২০ আষার কবি লিখলেন "হে মোর দূর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!"
এরই ১৩দিন আগে ১৩১৭ এর ৭ই আষাঢ় লিখলেন, "বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো/ নয়কো বনে, নয় বিজনে,/ নয়কো আমার আপন মনে,/ সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,/ সেথায় আপন আমারো!" লক্ষ্য করার বিষয়; কোনো রোমান্টিক ভাব বিলাসের মতো নিসর্গ প্রকৃতির নির্জন কোলে নয়! নয় আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের একান্ত ব্যক্তি সত্ত্বার অন্তর্জ্ঞানের অন্তরলোকে! বিশ্বদেবতাকে তিনি প্রত্যক্ষ করবেন নরনারায়ণের মধ্যে! "যেথায় . মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ-/ পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস!" (২৭ শে আষাঢ় ১৩১৭)এই সবই গীতাঞ্জলির নোবেলবিজয়ী সংকলনের লেখা! আশ্চর্য হতে হয় তারপরেও তাকে বুর্জোয়া কবি আখ্যা দেন কেউ কেউ!
ভাদ্র ১৩২১! সময়ের হিসেবে রুশবিপ্লবের আগে! কালান্তর গ্রন্থে সংকলিত "লোকহিত" প্রবন্ধটি এই সময়েই লেখা! কবি বললেন, "ধনের ধর্মই অসাম্য! জ্ঞান ধর্ম কালাসৌন্দর্য পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করিলে বাড়ে বৈ কমে না, কিন্তু ধন জিনিসটাকে পাঁচজনের কাছ হইতে শোষণ করিয়া লইয়া পাঁচজনের হাত হইতে তাহাকে রক্ষা না করিলে সে টেঁকে না! এই জন্য ধনকামী নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্ট করিয়া থাকে!তাই ধনের বৈষম্য লইয়া যখন সমাজে পার্থক্য ঘটে তখন ধনীর দল সেই পার্থক্যকে সমূলে ঘুচাইতে ইচ্ছা করে না, অথচ সেই পার্থক্য যখন বিপদজনক হইয়া উঠে তখন বিপদটাকে কোনোমতে ঠেকাইয়া রাখিতে চায়!" আর তখনই তার মতে অন্নের বদলে ঘুম পাড়াবার গান শোনানো হয় বেশি করে!
ইউরোপের রাষ্ট্রিক কাঠামোয় সামাজিক ধনবৈষম্যজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আরও বললেন,"এমনি করিয়া ধনের প্রকাণ্ড জালের মধ্যে আটকা পড়িয়া লোকসাধারণ ছটফট করিয়া উঠিয়াছে! ধনের চাপটা যদি এত জোরের সঙ্গে তাহাদের উপর না পড়িত তবে তাহারা জমাট বাঁধিত না- এবং তাহারা যে কেহ বা কিছু তাহা কাহারও খবরে আসিত না! এখন ও দেশে লোকসাধারণ কেবল সেন্সস্ রিপোর্টের তালিকাভুক্ত নহে, সে আর ভিক্ষে করে না, দাবি করে!" রোমান্টিক, আধ্যাত্মিক কবি সাম্যবাদের উদ্ভবের একেবারে গোড়ার কথা বললেন! এই বোধ থেকেই এক যুগ পরে তিনি হাত দেবেন রক্তকরবী নাটকে! তারও পরে যাবেন রাশিয়া! বলবেন রাশিয়ায় না গেলে তাঁর তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যেত!
কবি রাশিয়া থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখছেন ২০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৩০, "চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত! সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান! কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে- ! তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকে- উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে!"এই ব্রাত্যজনেদের প্রতি সভ্যতার বঞ্চনা: কোনোদিনের জন্য মেনে নিতে পারেননি কবি!
"....যে রকম দিন আসচে তাতে জমিদারীর উপরে কোনোদিন আর ভরসা রাখা চলবে না! ও জিনিসটার উপর অনেকদিন থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল এবার সেটা আরও পাকা হয়েচে ! যে সব কথা বহুকাল ভেবেচি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলুম! তাই জমিদারী ব্যবসায়ে আমার লজ্জা বোধ হয়! আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নীচে এসে বসেচে! দুঃখ এই যে ছেলেবেলা থেকে পরোজীবী হয়ে মানুষ হয়েচি!" লিখছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকেই (৩১/১০/১৯৩০) এই লেখাতেও জানা যায় রাশিয়ায় দেখে আসা সমাজতন্ত্রের চেহারার একটা খসড়া রূপ তাঁর ভাবনায় বহুদিনই ছিল! এই ভাবনার প্রকরণ থেকেই শ্রীনিকেতনের প্রয়াস! তাঁর ভাবনায় সমাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার বিষয়টি খুব দৃঢ় ছিল!
সমাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখতে চেয়েছেন কবি আগাগোড়া! তিনি অনুধাবন করেছিলেন এই স্বয়ংসম্পূরণতার মূল বাধা, ধনের অসম বণ্টন! ইউরোপের নকলে গড়ে ওঠা বড়ো বড়ো নগরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে সম্পদ! সমাজদেহের প্রাণকেন্দ্র থেকে, মানুষের হাত থেকে তাদের ধন কেড়ে নিয়ে পুঞ্জীভুত করছে যন্ত্র! তাই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "এই সব বড়ো বড়ো সঙ্ঘ, প্রতিষ্ঠান ধনকুবেরদের একটা স্বতন্ত্র জীবনধারা আছে! এদের সঙ্গে জনসাধারণের প্রাণের কোনো যোগ নেই; সুতরাং সমাজের সর্বত্র অসীম দুঃখ, বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য উপস্থিত হয়েছে!" তাঁর মতে, "আজ পৃথিবীতে ব্যক্তি- জনসাধারণ যন্ত্রের পেষণে প্রবল শক্তিশালী সঙ্ঘের অত্যাচারে আর্তনাদ করছে..! (আলবার্ট হলে ৪/৭/১৯২৭)
দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আর্থিক দৈন্যদশার মূল কারণ যে ধনের অসম বন্টন, সেই অসাম্যের বিরুদ্ধেই রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহ! তিনি আশা করেছিলেন নিপীড়িত জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ জোট এই অন্যায় অসম বন্টন ব্যবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটাতে সক্ষম হবে! আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস উপলক্ষে আলবার্ট হলে প্রদত্ত ঐ ভাষণেই তিনি এও বললেন, "মানুষ আজ বুঝতে পেরেছে, তারা যদি ধন ও শক্তিকে সেইভাবে কেন্দ্রীভূত হতে না দিয়ে নিজেরাই সমবেতভাবে তাকে প্রয়োগ করে, তবেই এই বৈষম্যের অবসান হয়, ইহাই সমবায় প্রণালী!" ফলে এরপর কবি যখন রাশিয়ায় গিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক রূপ দেখে এলেন , তখন তাঁর কল্পনার সেই বাস্তবায়ন তাঁকে বিশেষভাবে খুশী তো করবেই!
কবির ভাষায় "এ কালের এই যন্ত্রশক্তি দানবী শক্তি, বিরাট সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের শক্তি"র ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির এই শোষণবাদী চরিত্র সমস্ত সমাজদেহকে ফোঁপড়া করে দিয়ে একজন দুজনের দূর্গে পুঞ্জীভূত করে তোলে সমস্ত ধনসম্পদ! তাই কবি কল্পনায় উঠে এসেছিল সমবায় ভিত্তিক সমান্তরাল অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর রূপরেখা, যা অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে শোষণবাদী ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার দূরভিসন্ধিকে! আর রাশিয়ায় গিয়ে এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েই রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, "যে সব কথা বহুকাল ভেবেচি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলাম!" এই রবীন্দ্রনাথকে কি চিনেছি আমরা?
ধনতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক শোষণবাদী যান্ত্রিকতার যে যন্ত্রসভ্যতা, আজ আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে, আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগেই অসীম প্রজ্ঞার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ সেই বিভীষিকার অন্যায় বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন! ইউরোপের সমাজবাস্তবতার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মনুষ্যত্বের এত বড়ো অপমান আর কিছুতে হতে পারে না! তাঁর লেখায় বক্তৃতায় সৃষ্টিতে কর্মে তিনি নিজের মত করে এর বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিবাদ করে গিয়েছেন! প্রতিবাদ করে গিয়েছেন সেই সাধারণ মানুষের হয়ে, বঞ্চিত শোষিত অত্যাচারিত লাঞ্ছিত অপমানিত নরনারায়ণের হয়ে! যাদের জীবনের শেষ পরিণাম-- "কি যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কূটে!"
শোষণবাদী ধনবৈষম্যজাত ধনতান্ত্রিক যন্ত্র সভ্যতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদ "রক্তকরবী" প্রকাশ হল ১৩৩৩ [ডিসেম্বর ১৯২৬[ অবশ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে ১৩৩১ এর আশ্বিন মাসের প্রবাসীতে নাটকটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়! কবির ভাষায় বলতে হয়, বড়ো বিস্ময় লাগে! জমিদার রবীন্দ্রনাথ, সামন্ততান্ত্রিক উত্তরাধিকারের ঐতিহ্যে লালিত, এবং আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের অন্যতম বিশ্ববন্দিত প্রতিনিধি নোবেলবিজয়ী কবি; বিশ্বকে উপহার দিলেন- না সাম্যবাদের কোনো ম্যানিফেস্টো নয়! বিশ্বসাহিত্যের অতুলনীয় সম্পদ এক নাটক! শোষণজীবী সভ্যতার দানবীয় লোভ আর সেই লোভের বলি, মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের এক চিরন্তন গল্প!
আধুনিক যন্ত্রসভ্যতায় কবির কথায় মানুষই একমাত্র জীব যে মানুষকে খেয়েই ফুলে ওঠে! এটাই এই সভ্যতার চারিত্রলক্ষণ! এই যান্ত্রিকতার আর একটি মস্ত বড়ো লক্ষণ হল, পালোয়ানের সংলাপে, "সমস্ত পৃথিবীকে নিঃশক্তি করতে পারলে তবে ওরা নিশ্চিন্ত হয়!" শোষনবাদী এই যান্ত্রিক দানবীয় সভ্যতা মানুষের "জোর টুকুকেই নয় শুধু, একেবারে ভরসা পর্যন্ত শুষে নেয়!" বর্তমানের একমেরু বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রূপ কবি দেখে যাননি! কিন্তু কি অদ্ভূত ভাবেই না মিলিয়ে গিয়েছিলেন বর্তমান বিশ্বের মূল বৈশিষ্টটুকুকে! অত আগে, তাঁর অন্তর প্রজ্ঞায়! এখানেই এ নাটকের প্রবাহমান প্রাসঙ্গিকতা! সারা পৃথিবীর ধনসম্পদের অধিকার মুষ্টিমেয়র! বাকিরা "রাজার এঁটো!"
সেই রাজার এঁটোদের গল্পই তুলে নিয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ! যন্ত্রসভ্যতার শোষণ যন্ত্রে ধন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আপন শ্রম নিঙরে দিয়ে আঁখের ছিবড়ের মতোন যারা বেঁচে থাকে, এই আধুনিক বিশ্বায়নের যক্ষপুরীতে, তারাও ঐ রক্তকরবীর রাজার এঁটোর মতোন নয় কি? ধনতান্ত্রিক সভ্যতার এই দানবীয় লোভের যান্ত্রিকতার স্বরূপ কবি অনুভব করেছিলেন বড়ো নিবিড় ভাবে! শস্তার শ্রমের উপর সঞ্চিত ধনের ঐশ্বর্য্য ঝলমল করে! আর সেই ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে ঢাকা পরে যায় মানুষের হাহাকার! সেইখান থেকেই ঘুরে দাঁড়াবার কথা বলেন কবি! তিনি দেখতে পান দানবীয় এই যান্ত্রিকতাই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে শোষক শোষিত উভয়কেই! তখনি গণবিপ্লবের কেতন ওড়ান কবি, ব্রাত্যজনের হয়ে!
রাশিয়া থেকে রথীন্দ্রনাথকে লেখা পত্রে সভ্যতার যে পিলসুজদের কথা বলেছিলেন কবি, এ নাটকে তাদেরই এক্সপ্লয়টেশনের নিপূণচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি! শ্রমিকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ন্যূনতম স্বাধিকারচর্চার পরিসরটুকু দিতে রাজী নয় এই দানবীয় যান্ত্রসভ্যতার নির্লজ্জ লোভ! তাই ধন উৎপাদকদের ব্যক্তি পরিচয় নস্যাৎ করে তাদের যান্ত্রিক পরিচয় হয়ে যায় ৬৯ঙ, ৪৭ফ! মনুষ্যত্বের এই অপমানের বিরুদ্ধেই কবির তীব্র প্রতিরোধ তাঁর সৃজনশীলতায়! তাঁর কর্মসাধনায়! তাই রক্তকরবী তাঁর বিপুল সাহিত্যকীর্তির অন্যতম উজ্জ্বল সংযজোন নয় মাত্র! আধুনিক সভ্যতার যান্ত্রিক শক্তির এই অমানবিক চরিত্র আর নির্লজ্জ লোভের বিরুদ্ধে তার প্রত্যয়ী প্রতিরোধ প্রয়াস!
সভ্যতার পিলসুজদের উপর এই এক্সপ্লয়টেশনের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কবি তাঁর সমবায়নীতি প্রবন্ধে বললেন, "ইংরেজীতে যাকে বলে এক্সপ্লইটেশন, অর্থাৎ শোষণনীতি, বর্তমান সভ্যতার নীতিই তাই! ন্যূনাংশিক বৃহদাংশিককে শোষণ করে বড়ো হতে চায়; তাতে ক্ষুদ্র-বিশিষ্টের স্ফীতি ঘটে, বৃহৎ-সাধারণের পোষণ ঘটে না!" এই অন্যায় অসাম্যের বিরুদ্ধেই কবির প্রতিরোধ! তাই রাশিয়ায় গিয়ে অভিভূত হয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লিখছেন; "ধনশক্তিতে দুর্জয় পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাঙ্গণদ্বারে এই রাশিয়া আজ নির্ধনের শক্তিসাধনার আসন পেতেছে সমস্ত পশ্চিম মহাদেশের ভ্রূকুটিকুটিল কটাক্ষকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, এটা দেখার জন্য আমি যাব না তো কে যাবে?"
এই হলেন ব্রাত্যজনের রবীন্দ্রনাথ! তিনি না গেলে আর কে যাবে! ঐ পত্রেই লিখলেন, "রাশিয়ায় না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত!"যদিও শেষ বয়সের এই তীর্থদর্শনের বহুযুগ আগেই তিনি বুঝেছিলেন ,ভোগ্য উৎপাদনের যথাযথ ভাগবাঁটয়ারা"র অভাবের মধ্যেই সভ্যতার মূল সমস্যার বীজ নিহিত আছে! আর সেখানেই ক্ষমতাধরের হাতে নির্ধনের উপর প্রবল উৎপীড়ন ও অত্যাচার মানবসভ্যতায় সত্বঃসিদ্ধ! সেই সামূহিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবি আজীবন সোচ্চার ছিলেন! তিনি দেখেছিলেন যুগব্যাপী শোষণের শাশ্বত রীতি বদলায়নি, নিত্য নতুন শোষণযন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে শুধু! আর এ সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের স্বার্থান্ধতার কারণে, ভেদবুদ্ধি অবুদ্ধির মধ্যে!
আর এই স্বার্থান্ধ ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে কবি আমাদের বারবার সচেতন করে দিয়েছেন! রক্তকরবীতে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন গণবিপ্লবের! হয়ত রুশবিপ্লব তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল! তিনিই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন যন্ত্রসভ্যতার যান্ত্রিকতার অভিশাপ! এই অভিশাপ শুধু শোষিতকেই মারে না, যান্ত্রিক এই সভ্যতার শোষণবাদী অধিপতিরাও শোষণবাদী যন্ত্রসভ্যতার এই প্রক্রিয়ার অভিশাপ থেকে রেহাই পায় না! এখানেই কবি সমাজতান্ত্রিক দার্শনিকদের থেকেও কয়েকধাপ এগিয়ে সমস্যার একেবারে গোড়ায় গিয়ে অভিশাপের মূলোৎপাটনের কথা বললেন! সেই মূলোৎপাটনের গল্পই রক্তকরবীর গল্প! ব্রাত্যজনের কবি নতুন সভ্যতার আহ্বান করলেন এ নাটকে! অভিশপ্ত সভ্যতার ভগ্নাবশেষের উপরে!
তবু কবি বললেন, "আমার কবিতা, আমি জানি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী!" তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন, "যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি!""শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে" যারা কাজ করে সেই ব্রাত্যজনদের কবি ১৯৩৮ এর ২৮শে ফেব্রুয়ারি Manchester Guardian এ লিখলেন, "The future lies in our learning to ally ourselves with those human forces in the world; wherever found; which are seeking to end altogether the exploitation of man by man; and of nation by nation.""বিশ্বে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে নির্যাতিত জনগণের জীবন ও স্বাধীনতার সৌষ্ঠব!"বলেলেন ব্রাত্যজনের রবীন্দ্রনাথ!
বর্ধমান ।
সুন্দর লেখা
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন