ইন্দ্রাণী সরকার

গ্রান্ড ক্যানিয়নঃ

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত একটি গিরিখাতের নাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সবচেয়ে বড় বা সবচেয়ে গভীর, এর কোনোটি না হওয়া সত্ত্বেও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গিরিখাত। মূলত অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে এই খ্যাতি এনে দিয়েছে। গিরিখাতটির মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কলোরাডো নদী। ৪৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, সর্বোচ্চ ১৮ মাইল পর্যন্ত প্রস্থ এবং ১৮০০ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বেশির ভাগটিই পড়েছে বর্তমান গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে। এর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া কলোরাডো নদীই মূলত গিরিখাতটি উৎপন্ন হওয়ার মূল কারণ বলে ধারণা করেন গবেষকরা। তবে উৎপন্ন হওয়ার সময় থেকে বর্তমান অবস্থায় আসতে সময় লেগেছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ বছর। 

গবেষকরা ধারণা করেন, কলোরাডোর চলার পথে বিভিন্ন স্থানে এক সময় প্রচুর পলি জমে। ধীরে ধীরে সেসব পলি পাথরে পরিণত হয়। ফলে নিজের নিয়ে আসা পলিতেই বাধা পায় কলোরাডো। পাল্টে যায় নদীর গতিপথ। আবার নদীর স্রোতে ক্ষয় হতে থাকে পলি জমা পাথর। বছরের পর বছর এ প্রক্রিয়ার পর বর্তমান চেহারা পেয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। স্তরে স্তরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যে পাথরগুলো সাজানো রয়েছে এগুলোকে বলা হয় কলোরাডো প্লেট। এসব প্লেট তৈরিতে কলোরাডো নদীর বিরাট অবদান থাকার কারণেই নদীটির নামের সঙ্গে মিল রেখে এদের কলোরাডো প্লেট বলা হয়। পুরো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি নর্থ রিম ও অন্যটি সাউথ রিম। দুটি অঞ্চলেই গ্রীষ্মে যেমন বৃষ্টিপাত হয় শীতে হয় তেমনি তুষারপাত। তবে এর মধ্যে নর্থ রিমটাই দুর্গম বেশি| কোনো কোনো জায়গা থেকে একে দেখে মনে হয়, এটি চারদিকে নানা উজ্জ্বল বর্ণ সমন্বিত অট্টালিকা এবং দুর্গসমৃদ্ধ প্রস্তর নির্মিত জাদুর শহর। গ্র্যান্ড কানিয়নের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য পরিদর্শনের জন্য প্রতি বছর ১.৫ মিলিয়নের অধিক পর্যটক ওই অঞ্চল পরিদর্শনে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন | 

লাস ভেগাস থেকে আমরা রেন্টাল গাড়ি চালিয়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে এসে পৌছলাম | তখন বিকেল হয়ে গিয়েছিল | হোটেলে জিনিসপত্র রেখে আমরা ঠিক করলাম ক্যানিয়নে সূর্যাস্ত দেখতে যাব | হোটেলের কাছেই যে স্পট টা ছিল সেখানে গাড়ি পার্ক করে ভিউয়িং এরিয়াতে এসে দাঁড়ালাম | অনেক দর্শকের ভিড় চারিধারে | কি অভূতপূর্ব সেই দৃশ্য ! 

গ্রান্ড ক্যানিয়নের বিশালতা এবং এর দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য্য কলম দিয়ে বর্ণনা করতে গেলে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলি | এ যেন প্রকৃতি এবং মানুষের সহাবস্থানের অন্তহীন সিম্ফোনী, যেন স্তব্ধতার জালে আছন্ন এক স্বপ্নপূরী, যার শুরু এবং শেষ নিয়ে শুধু কল্পনা করা যায়, দেখা পাওয়া যায়না। স্লো মোশনে উড়ে যাওয়া চিল গুলোর দিকে তাকালে মনে হবে পৃথিবীটাও যেন পদানত এই পাখীগুলোর ডানার কাছে। যতদূর চোখ যায় শুধু ধূসর লালের মেলা, মাঝে মধ্যে হাল্কা মেঘ এসে গ্রাস করে নেয় ক্যনিয়নের চূড়াগুলো। এক একটা চূড়া মনে হবে তাজমহল, কুতুব মিনার, বৌদ্ধ অথবা খ্রীষ্টানদের উপাসনালয় এবং এদের সংখ্যা লাখ লাখ। সবচেয়ে দামী মুহুর্তটা বিমূর্ত হয়ে ধরা দেয় সূর্য্যাস্তের সময়। রক্তিম সূর্য্যের বিদায়ী আভা গ্রাস করে নেয় ক্যানিয়নের গভীরতা, মনে হবে কেউ যেন কোটি কোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে উপাসনায় বসেছে। এ শুধু দেখার জিনিষ, অনুভব করার জিনিষ, বলার জিনিষ নয়। হাজার হাজার পর্য্যটক প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য ফ্রেমে আটকানোর জন্যে চাতক পাখীর মত অপেক্ষায় থাকে সারাটা দিন।

গাড় কমলারঙের সুর্য্য তার অস্তরাগের রং দিয়ে ক্যানিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে | ধীরে ধীরে সুর্য্য একটি গিরিচূড়ার পিছনে লুকিয়ে গেল | কতক্ষণ সেই আলোর আভার রেশ থেকে গেল অন্ধকার ধীরে ধীরে উপত্যকাকে গ্রাস করার আগে পর্য্যন্ত | মোহাচ্ছন্ন ভাবে সবাই হোটেলে ফিরে এলাম |

সূর্যোদয় এখানকার বড় আকর্ষণ। পর দিন তাই অন্ধকার থাকতেই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের আগেই, অরুণোদয়ের জন্য ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন অনেকেই। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। নীচে পাথরের স্তর, বিভিন্ন আকারের, মনে হচ্ছিল সে সব মন্দির আর প্রাসাদ। নামকরণও তেমন— শিব, ব্রহ্মা, বুদ্ধ মন্দির। পুবাকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আমরা— বিভিন্ন দেশের লোক। অবশেষে ‘সোনার থালা’ মুখ দেখাল। আলো ফুটে তৈরি হল অপূর্ব এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ঠান্ডা হাওয়া ঝড়ের মতো বইছে ঠিকই, কিন্তু থামাতে পারছে না উচ্ছ্বসিত দর্শকদের। 

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ধারেই কাচের বড় বড় ঘর। দর্শকরা সেখান থেকে টেলিস্কোপে দেখছেন কলোরাডো নদী, অনেক দূর পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে সাজানো পাথর আর ও-পারের নর্থ রিমকে। সাউথ রিমে অনেকগুলো ‘সাইট সিইং স্পট’ রয়েছে। সেই সব স্পটে পৌঁছতে রয়েছে দশ মিনিট অন্তর বাস পরিষেবা। বাস থেকে পর্যটকরা নেমে পড়তে পারেন ইচ্ছানুযায়ী যে কোনও স্পটে। এ সব জায়গা থেকে নানা ভাবে দেখা যায় গিরিখাতের অপার সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে, কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছেন পরিষেবার দিকেও। খাদের ধারে ‘ফেন্সিং’, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার জায়গা— দর্শকদের সুবিধার্থে আছে সব কিছুই। আশপাশের মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ, নীলগাই। ঘণ্টা পাঁচেক ছিলাম এই গিরিখাতের পাশে। উপভোগ করেছি প্রত্যেকটা মুহূর্ত।


নিউইয়র্ক ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.