মৌ দাশগুপ্তা










শ্লীলতাহানি থেকে ধর্ষণ, এর শেষ কোথায়?




ধর্ষণ নিয়ে মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে। প্রতিবাদে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে।কিন্তু কিভাবে? দু চার পাতা লিখে ? কি হবে লিখে? পত্রিকার দরকার খবর, টিভির দরকার হট কেক নিউজ। ধর্ষকের শাস্তি ঠিক মতো হলো কিনা, এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথাই থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ষণ নিয়ে লিখে আসলে আমরা ধর্ষিতাদের ব্যাঙ্গই করি।

মানুষের ইতিহাসে আজও আমরা মেয়েরা বিশ্বের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, কী স্বদেশে, কী বিদেশে। নারীরা এগিয়ে চলার পথে ধর্ষণ হল সবচেয়ে সাধারন সমস্যা। যা খুব সহজেই একটি মেয়েকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে বিকলাঙ্গ করে দিতে পারে। ধর্ষণ হলো এমন এক প্রকার যৌন লাঞ্ছনা যার সাথে শারীরিক সম্পর্ক জড়িত, যা কিনা অনুমতি ব্যতীত শারীরিক বল প্রয়োগ করে, জোর করে কাউকে শারীরিক মিলনে বাধ্য করে । ধর্ষণ কেন করা হয়? শারীরিক আনন্দের জন্য, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, কিংবা শুধু মাত্র বিকৃত সুখ লাভ করার জন্য ।

নারীর প্রতি উদার হিসেবে পরিচিত পশ্চিমী বা অমুসলিম দেশ যেমন দক্ষিন আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া,কানাডা,জিম্বাবুয়ে,এমনকি খোদ আমেরিকার মত দেশগুলিতে ধর্ষণের হার এবং নারীর শ্লীলতাহানী পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় আশংকাজনক হারে বেশী।এ ধারাবাহিকতায় আমেরিকায় প্রতি ১০ লক্ষ নারীতে ৩০১ জন ধর্ষিতা হন। আন্তঃর্জাতিক ভাবে সর্বনিম্ন মিশরে প্রতি ১ লক্ষ নারীর মাঝে ০.১% নারী ধর্ষণের শিকার হন।যেখানে পঞ্চম স্থানে থাকা ওমানে প্রতি ১০ লক্ষ নারীতে মাত্র ১৮ জন ধর্ষিত হয়! আরো বলি? সর্বোচ্চ আফ্রিকার একটি দেশ লিসোথু বা লিছুটু (Lesotho) তে প্রতি ১ লক্ষ নারীর ৯১.৬% নারী ধর্ষণের শিকার হন।

ছোটবেলায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটা খবরের কাগজ কি সাময়িক পত্রিকা থেকে শিখেছিলাম,আজ আর ঠিক মনে নেই। বন্ধুরা কেউ কেউ বলতো ‘নষ্ট হওয়া’। 

ধীরে ধীরে দেখলাম আমাদের সমাজে মানুষ ধর্ষণকে একটা একজন নারী ধর্ষিত হলে তিনি ‘নষ্ট’ হয়ে যান! অর্থাৎ যিনি ধর্ষিতা হন তাঁর সন্মান বা মান-মর্যাদার ‘হানি’ হয় । আর তখন শুধু নারী নয়, সমাজের পুরুষ মানুষগুলোও ধর্ষিতাকে দেখে সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলা মানুষ হিসেবে। এবার, ধর্ষিতা নারীটির মনস্তত্ত্ব যদি খেয়াল করি তবে দেখা যাবে, ওই নারী ধর্ষণ পরবর্তী শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রনার সাথে ভুগতে থাকে সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলার গ্লানিতেও। সে আমাদের কাছে ‘লজ্জায়’ মুখ দেখানোর সাহস পায় না। শেষ পর্যন্ত বিচার হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুপাপে লঘুদণ্ডের নামান্তর হয়ে দেখা দেয়। এসব দৃষ্টান্ত দেখেই হয়তো সংশ্লিষ্ট নারী প্রতিকারের পথ রুদ্ধ ভেবে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। শুধু তাই না, যেহেতু ধর্ষিতা হওয়া মানেই তা নিদারুন লজ্জা বা গ্লানির ব্যাপার, তাই এটা গোপন করে রাখতে হবে, আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজ বয়ে বেড়াচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে।এতেই তো ধর্ষণকারীর পোয়াবারো। তার ওপর ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে গ্রামাঞ্চলে এখনো ধর্ষিতাকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া হয় ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে। কী মর্মান্তিক!

জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে চলতি বছর বেড়েছে, ইভটিজিং-এর জেরে দায়ের হওয়া অভিযোগের সংখ্যা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ সালে ইভটিজিং, শ্লীলতাহানী ইত্যাদি সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের হয়েছে মোট ৩৬৯টি।২০১০-১১ সালে এই ধরণের অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৩৩৬টি। ২০০৯-১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৬৪টি। ইভটিজিংয়ের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তালিকার শীর্ষে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র। জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১১-এ অন্ধ্রপ্রদেশে মোট ৩ হাজার ৬৫৮টি ইভটিজিংয়ের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। দেশের নিরিখে যা ৪২.৭ শতাংশ। মহারাষ্ট্রে ক্ষেত্রে সংখ্যাটা এক হাজার ৭১।

দেশের নিরিখে তা ১২.৫ শতাংশ। মধ্যপ্রদেশ এবং কেরলে নথিভুক্ত ইভটিজিংয়ের ঘটনা যথাক্রমে ৭৬২টি এবং ৫৭৩টি। তবে জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সবকটি মেট্রোসিটিই এখন মহিলাদের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিজয়ওয়াড়ায় গত বছর মোট ৩৫৫টি ইভটিজিংয়ের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। মুম্বাইয়ে ১৬২।
দিল্লি শহরের হিসাবে সংখ্যাটি হলো ১৪৯টি। কলকাতায় ২০১ তে ইভটিজিংয়ের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে মোট ১৪৪টি। চেন্নাই-এ হয়েছে ১২১টি।

খুব অল্প কথায় ধর্ষণের কারন বিশ্লেষন করা খুবই কঠিন। আসলে, ধর্ষণ একটি মানসিক বিকৃতি। একজন মানুষের মনুষ্যত্ব যখন শূন্যের কোঠায় চলে আসে তখনই সে ধর্ষণ নামক একটি বিকৃত অপরাধ করে।ধর্ষণের আরো কিছু কারন হচ্ছে ইভটিজিং, অপসংস্কৃতির প্রভাব, মোবাইল পর্ণোগ্রাফি এবং আইনের শাসন প্রয়োগের দূর্বলতা। ইভটিজিং যারা করে তারা যদি সঠিক সময়ে বাধা না পায়, বা সংশোধনের সুযোগ না পায় তাহলে তারা পরবর্তীতে ধর্ষক হিসেবে পরিনত হয়। আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পর্ণোগ্রাফি এখন খুবই সহজলভ্য একটি বিষয়। বিশেষ করে মোবাইল পর্নোগ্রাফি । এই সবক্ষেত্রে পুলিশের ভুমিকা ঠুঁটো জগন্নাথ এর মত। আইন থাকলেও কোন প্রয়োগ নেই। নেই কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদহারনও। ফলে ব্যবহারকারীরা উৎসাহিত হয়ে যেন তেন প্রকারেন নারীদেহ চেখে দেখতে চায়, আর যদি সফল না হয় তাহলে বিফলে মূল্য ফেরতের মত বিফলে ধর্ষণ করে তারা।আমি মনে করি পোষাক, আচরন ইত্যাদি ক্ষেত্রে শালীনতার যে বিষয়টি বার বার বলা হচ্ছে তা মূলত শুধু কোন এক পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং শালীনতা একটি সার্বজনীন ব্যাপার। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি সমান ভাবে প্রযোজ্য। যারা শুধু মাত্র নারীর পোষাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী করেন তারা সংকীর্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। শুধুমাত্র অশালীন পোষাকের কারনে ধর্ষণ - কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।বোরখা দিয়ে শরীর ঢাকলে কি কোন মহিলা ধর্ষিতা হন না? এ দেশেই তিনমাস বয়সের মেয়ে শিশু থেকে সাত বছরের বালিকাও তো ধর্ষণের শিকার,এখনে পোষাকী শালীনতা কোন অর্থ রাখে কি? ধর্ষণের উদ্দেশ্যটাই তো ভীতিপ্রদ।

• প্রথমত, যৌন লালসা চরিতার্থ করাটাই বুঝিবা ধর্ষণের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য, তবে সেটা অবশ্যই বিকৃত যৌনলালসা!
• দ্বিতীয়ত, অনেকসময় শত্রুতামূলকভাবেও ধর্ষণ করা হয়।
• তৃতীয়ত, রেপের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে ধর্ষণের পর রোমহর্ষকভাবে হত্যা করা ।
সত্যি কথা বলতে কি, আমার কাছে ধর্ষণ করার পিছনে সারাজীবনই চিন্হিত হয়ে আসবে নিম্ন এবং বিকৃত রুচি, এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং হীন পারিবারিক শিক্ষা। কিছু রেপিস্ট আছে যারা উচ্চশিক্ষিত কাপুরুষ এবং মানসিকভাবে বিকৃত এবং অবশ্যই বাড়ীতে সুন্দরী বউ বা গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্বেও এরা ধর্ষণ করে শুধুমাত্র মানসিক তৃপ্তি পেতে, এরা মানসিকভাবে অসুস্হ।এদের চিকিৎসা করা ছাড়া অন্য কোন সমাধান নেই।

যৌন হয়রানির চরম ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর ফলশ্রুতিতে অন্যন্য সমস্যা হয়রানির শিকার হওয়া নারীর সাথে সাথে পরিবার এবং সমাজেও বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।যে সকল নারী একইসাথে যৌন এবং শারীরিক অত্যাচারের শিকার হন তাদের মধ্যে যৌনবাহিত রোগ সংক্রমনের সম্ভাবনা বেশি দেখা দেয়।বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় বত্রিশ (৩২,০০০) হাজারের বেশি নারী ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্বা হয়ে পড়েন।যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারী ঘটনা পরবর্তী এবং দীর্ঘস্থায়ী মনস্তত্ত্বিক সমস্যায় পতিত হতে পারে।এছাড়াও ঘটনা পরবর্তী সমস্যার মধ্যে আছে -নিজেকে অপবিত্র মনে হতে থাকা, নিজেকে অপরাধী মনে করা, অন্যের প্রতি অবিশ্বাস জন্মানো, ঘটনা পরবতী মানসিক চাপ অনেক সময় উন্মাদ হয়ে যাওয়া, আত্মহত্যার চেষ্টা করা কিংবা আত্মহত্যা করাতেও পরিবর্তিত হয়।যৌন হয়রানির / ধর্ষণে সামাজিক ভাবেও নারী নানাবিদ সমস্যায় পতিত হয়, ভুক্তভুগি এবং তার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আন্তরিকতাশূন্য সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।বিয়ের প্রস্তাব আসেনা এমনকি যারা বিবাহিত তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাবারও সম্ভাবনা প্রকট হয়। 
(তথ্যসুত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার পর ইনজুরি প্রিভেনশান এন্ড কন্ট্রোল, ডিভিশন অব ভায়োলেন্স পিভেন্ট।)

একটি মেয়ে, মনে তার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা, কিন্ত কিছুই পুরন হলো না । তাকে চলে যেতে হলো অকালে অসময়ে- কোন মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা না, কোন মারাত্মক রোগ না, ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাসও না -তাকে জীবন দিতে হলো কিছু নরপশুদের লোভে শিকার হয়ে ।না কোনো পুর্বশত্রুতা নয়,নয় কোনো সম্পদের লোভ। তার শুধু দোষ ছিল কি এই, যে- তার একটি শরীর আছে যা পশুদের মনে কামনা জাগাতে পারে। সেই শরীরটার কারনেই তাকে চলন্ত বাসে একের পর এক অত্যাচার করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হোল, কি রাস্তা থেকে অন্ধকার মাঠের কোনে টেনে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচারের শেষে বেঘোরে খুন করা হোল । এবার এই কামদুনির ব্যাপারেই আরেকটা কথা বলি, একটা অল্পবয়সী মেয়েকে একলা পেয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা নররূপী নরকের জীব গ্যাঙ রেপ করেছে। যারা করেছে, তারা কি চিনে ফেলবার ভয় পেয়েছিল? না। কারণ তারা ডেসপারেট। । তাই ভয়ে মেরে ফেলেছে বলা যাবেনা। আর সেই জন্যই মারা হলে, গলাটিপে মারলেই চলত।দিল্লীর মেয়েটিকে তো চিনে ফেলারও ভয় ছিলনা। কিংবা অনিতা দেওয়ানের কথাই ভাবুন না! আসলে এগুলো 'ধর্ষকাম' বা স্যাডিজমের চূড়ান্ত রূপ। এদের ‘শাস্তি' দেয়া হয়েছে, কারণ এরা মিউ মিউ করে সাবমিট না করে খানিক ব্যর্থ প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল।পরিবর্তনের পরে রাজ্যের নানা প্রান্তে যে ভাবে প্রায়শই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্বজ্জনেদের উদ্বেগের কারণ৷ পার্ক স্ট্রিট, নিউ টাউন, কাটোয়ার ধর্ষণ কান্ড নিয়ে কয়েক মাস ধরেই তোলপাড় চলছে রাজ্যে। ই এম বাইপাস বারাসত, নৈহাটির নারী নিগ্রহের ঘটনাও আমাদের নজর এড়ায়নি। কামদুনির ঘটনার পরপরই পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার গেদেতে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে। বে এত সব ধর্ষণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রতিবাদগুলো হয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারগুলো ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। যতদূর মনে পড়ে সম্প্রতিকালে দিল্লীর দামিনী ধর্ষণ এবং হত্যা নিয়েই প্রথম ব্যাপক ও স্বতঃস্ফুর্ত জনাবেগ প্রকাশ পেয়েছিল।দেরীতে হলে ও অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপর আরো অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও তেমন বড় আকারের কোন সামাজিক আন্দোলন ঘটে নি।কিন্তু ধর্ষণ ঘটেছে। জানাজানি হয়েছে। সচেতন জনতার পুঞ্জীভুত ক্ষোভ ফুটন্ত লাভা হয়ে ফুটেছে মনের গভীরে। কত আর সহ্য করবে মানুষ? বারাসতের কামদুনির ঘটনা সেই জমতে থাকা ক্ষোভে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে৷ প্রতিবাদে মুখর হয়েছে কামদুনি৷ সেই প্রতিবাদী কণ্ঠ নাড়া দিয়েছে রাজ্যের নাগরিক সমাজকে৷

যারা এই বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন করছেন তারা অনেকেই ধর্ষণের শাস্তির হিসাবে একমাত্র মৃত্যুদন্ডের কথা বলেছেন। আমি আইনের লোক নই, মৃত্যুদন্ডের আমিও বিরোধী। ধরে নিলাম বিচার ব্যাবস্থা ফুল প্রুফ হয়ে গেল, মানে কোন নিরপরাধ ফেঁসে যাচ্ছে না। তাহলে কি, এই বারাসাত কান্ডের অপরাধী 'মানুষ'রা সংশোধনের সুযোগ পাক আমি চাইবো? যারা একটি মানুষকে ধরে স্রেফ ছিঁড়ে ফেলতে পারে, তারা কি মানুষ? এবার কেউ যদি বলেন,মৃত্যু মানে তো শেষ, অপরাধীরা তো যথেষ্ট শাস্তি পেলনা।তা ঠিক ... কিন্তু না পেলেই বা কি। আর মৃত্যুদন্ড অপরাধ কমাতে সাহায্য করবে, এরকম কিছুও মনে করিনা। তখন আমি বলব, তাহলে মোমবাতিই আপনাদের একমাত্র সলিউশন। আফটার অল প্যারাফিন ওয়াক্সের বাজারটাতো বাড়বে।
ভারতে ধর্ষণ বিরোধী অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। এর ফলে কয়েক দশক ধরে চলা ভারতে ধর্ষণের বিরোধী আইন পরিবর্তন হয়ে গেল।ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরোধী এ অধ্যাদেশ আনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নির্যাতিতা যদি মারা যায় অথবা মানসিক বিকৃতি ঘটে সেক্ষেত্রে শাস্তি সর্বনিম্ন ২০ বছরের কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ফাঁসি।নতুন অধ্যাদেশে বদলে গেছে ধর্ষণের সংজ্ঞাও। এতে একাধিক ধরনের নির্যাতনকে যৌন নিগ্রহের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে অ্যাসিড হামলা। এছাড়া, মেয়েদের পিছু নেয়া বা অন্য কোনো ভাবে তাদের হেনস্থা করাকেও অপরাধের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মেয়েদের উত্যক্ত করা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত শাস্তির কথা বলা হয়েছে এই অধ্যাদেশে।বিচার বিভাগের দুর্বলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সর্বোপরি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলেছে। নারীত্বের সম্মান , সম্ভ্রম ও জীবননাশ করে সমাজে বিচরণশীল পৈশাচিক শক্তি ক্রমাগত নষ্ট করছে মাতৃজাতির মর্যাদা ও অধিকার। এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ-গণধর্ষণ কী নয়! ধর্ষণজনিত মৃত্যুর কারণে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের দেশের প্রতিটি প্রান্তে, যেভাবে নারীসমাজ মাঠে নেমেছে সেভাবে সর্বত্রই প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গেই আমরা পরিচিত কিন্তু এর বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের সঙ্গে পরিচিত নই, যা এই অবক্ষয়ী সমাজে প্রয়োজন।

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই,ধর্ষণ নিয়ে কোন রাজনীতি নয়,ধর্ষণ নামক সামাজিক একটি ব্যাধিকে ধ্বংস করতে একাত্মতা ঘোষণা করে , ধর্ষণকে চিরতরে নির্মূল করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার । তাই সবাইকে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন হয়ে এর প্রতিরোধ এবং উচ্ছেদের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।যে সমাজব্যবস্থা নিরন্তর ধর্ষকের (অপরাধি)জন্ম দেয়, আমরা কিন্ত সেই সমাজেরই অংশ; সেই ধর্ষকও কিন্ত কারুর না কারুর ছেলে কিম্বা ভাই বা স্বামী। সেই ধর্ষক কখনও পরিবারের একজন, কখনও প্রশাসনের একজন। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ধর্ষিতার সার্বিক, পুনর্বাসনের ব্যবস্তা করুক সরকার। ধর্ষকদের ফাঁসি দিলেও নতুন নতুন ধর্ষকের আবিভার্ব হতেই থাকবে যতদিন না আমাদের দেশে সুশিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক প্রশান্তি আসে।তসলিমা নাসরিন আক্ষেপ করেছেন ধর্ষণ সেইদিন বন্ধ হবে যেদিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে ! কিন্ত সেই দিনের আশায় বসে থেকে আজ শুধু অপরাধির শাস্তির দাবী করলে আগামীদিনে নিজের সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারবো না, এটা নিশ্চিত। পরিশেষে আমি বলতে চাই, আমরা চাই না আমাদের দেশের আর কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হোক। আমরা চাই না আমাদের দেশের কোন নারী মাথা নিচু করে চলুক। আমরা চাই না আমাদের দেশের কোন নারী রাস্তায় আতংক নিয়ে চলুক। আমাদের তীব্রভাবে আন্দোলন করে সরকারকে চাপে ফেলতে হবে ধর্ষণের অভিযোগে কঠিনতর আইন প্রনয়নের জন্য । আমি এগিয়ে আসলে আমার দেখাদেখি আরো দুজন এগিয়ে আসবে, এই মতাদর্শে চলতে হবে আমাদের।

“আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন...
দ্বিগুন জ্বলে যেন, দ্বিগুন দারুন প্রতিশোধে, করে চুর্ণ ,ছিন্নভিন্ন ,
শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন.. আনে মুক্তি শত প্রানে.....”

কলকাতা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.