ফারহানা খানম

কথা দেয়া ছিল

সকাল সকাল এই দৃশ্যটা অকল্পনীয় আর অসহ্য ,অদিতি রাগ করবে না দেখবে ভেবে পেলো না অগত্যা চা এর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। এসময় ভাইয়া এলো তিনিও নির্বাক ,কিছুক্ষন পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যা যা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । অদিতি বলল কি করলে ভাইয়া ? ইসশ পাখিটা ধরা যেতনা ? এসময় চোখ মুছতে মুছতে মিমিও এসে পড়েছে ,সে শুধু দেখলো ৪/৫টা সবুজ টিয়া উড়ে যাচ্ছে , তার বায়না ওটা চাই । এই হৈ চৈ এ পাশের বাড়ির দোতালায় মুকুল গান থামিয়ে ক্যমেরা নিয়ে ছবি তুলছে ...অয়ন চেঁচিয়ে বলল ভাইয়া আমি একটা ছবি তুলেছি , এদিক থেকে অনিক বলল যাক তুমি দুর্লভ দৃশ্যটা ধরে রেখেছ তাহলে ? আমায় দিও ছবিটা ।

রোজ ভোরে নামাজ শেষ করে খালি পায়ে বাগানে হেঁটে হেঁটে অদিতি আর অনিক চা খায় , গাছগুলো দেখে পানি দেয় পরিচর্যা করে পুরনো ফুল তুলে নেয় ঘর সাজায় এ সময় পাশের বাড়ির অয়ন এর বোন মৌ আসে , ওপাশের দোতালা বাড়ির শানু চার তালার মামুন তিন তলার রুপা এসে ফুল নিয়ে যায় ।, তারপর শুরু হয় পড়াশুনা ।অদিতি পড়ে ক্লাস টেনে অনিক ভার্সিটিতে পড়ছে ২য় বর্ষে ।

বাগানটা দুই ভাইবোনের নিজের হাতে করা কোন মালি নেই ,অদিতি আর অনিক দুজনে দেশী -বিদেশী ফুলের গাছ লাগায় খুব যত্ন করে, আবার পরের মৌসুমে লাগাবে বলে বীজ তুলে রাখে নিয়ম করে । শরতে শিউলি গাছটার নিচে যখন রাশি রাশি শিউলি পরে থাকে সবুজের বুকে শিশির জড়ানো শিউলি কি যে অপুর্ব দেখায়!কিংবা জ্যোৎস্না রাতে যখন চন্দ্রমল্লিকা বা হাস্নাহেনা ফোটে কি সুন্দর যে দেখায় ফুলগুলো যেন এক একটা নক্ষত্র ! ওদের আনন্দের জায়গা এই বাগান ।

তা আজ যে ঘটনা ওদের যুগপৎ অবাক আর রাগান্বিত করেছে তা হল বারান্দার ধারের যে বেড তাতে সূর্যমুখীর ১২ টা গাছ তাতে বিরাট বিরাট খয়েরী -হলুদ সূর্যমুখী ফুটে ছিল । ত সকালে নিয়ম মাফিক অদিতি চা এর কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দেখল ৩/৪ টা টিয়ে পাখি সূর্যমুখী ফুলের খয়েরী বীজ খুঁটে খাচ্ছে আর হলুদ পাপড়িগুলো তছনছ হয়ে আছে , এ দৃশ্য অকল্পনীয় আবার নির্মম সুন্দর, অদিতির মনে হচ্ছিল যেন পাখিগুলো ওর বুকে ঠোকর দিচ্ছে! তখন ভাইয়াও এসে নির্বাক তাকিয়ে থাকে ।

ঠিক এই সময় প্রতিদিন অয়ন বারান্দায় বসে রেওয়াজ করে সে প্রথম বারান্দায় এসেই এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মোবাইল নিয়ে এসে ঘর ছবি তুলতে তৈরি হয় আর একটা ছবি তুলতেই নিচে গোলমাল বেঁধে যায় পাখিগুলো উড়ে চলে যায় । মিমি পাখির জন্যে কান্না জুড়ে দেয় । ওকে শান্ত করতে ব্যস্ত সবাই ।

ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশে নীল কমে গাঢ় হচ্ছে সাদা আর সোনালী আভা । কয়েকটা প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে। সুন্দর ঝির ঝিরে হাওয়া । বেশ কিছু নতুন ফুল ফুটেছে অদিতি আর অনিক বাগানে নেমে গেল গাছের পরিচর্যা করতে হবে , ,ফুল নিয়ে সাজাতে হবে । অনিক গাছে পানি দেয় আর অদিতি ফুল তুলতে থাকে মৌ কে কিছু ফুল দিল, সে নিজে কিছু গাঁদা ফুল নিয়ে উঠে পড়লো । অয়ন ওপর থেকে বলল আমার জন্যে কিন্তু ৩ টে গোলাপ দিও অদিতি ,৩ টি গোলাপ কুঁড়ি দিয়ে দিল তুলে । ফুটন্ত গোলাপগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে আছে সেগুলো সে ধরলো না , বাকী যে কটা আছে তা ধরলেই ঝরে যাবে । উঠে এল ওরা বাগান থেকে বেলা বাড়ছে ঝকঝকে রোদ কিন্তু বার বার মনে পড়ছে খতবিক্ষত ফুলগুলোর কথা ।

নাশ্তার টেবিলে মা জিজ্ঞেশ করেন কিরে সকালে কি নিয়ে এত গোলমাল হলরে ? মিমি মহা উৎসাহে ঘটনা বর্ননা করে এও বলে তার একটা টিয়া পাখি আজই চাই , মিমি পড়ে ক্লাস ফোর এ ।বাবা হেসে বলেন বেশতো রুনু তুমি কাঁটাবন থেকে ভালো দেখে একটা পাখি কিনে দাও ওকে তবে হ্যাঁ মামনি পাখিটাকে কিন্তু তুমি কথা শেখাতে হবে ।মিমি বলে বেশ শেখাবো । সবাই হাসতে থাকে ।

অদিতি নিজের ঘরে এসে পড়তে বসে। একটু পরেই স্কুলে যেতে হবে । মৌ আর অদিতি একই স্কুলে পড়ে একটু পড়েই ওরা যখন রেডি সেসময় অয়ন আসে । এ বাড়িতে ওদের আর ওই বাড়িতে এদের অবাধ যাতায়াত । কেউ কিছু মনে করেনা অয়ন এসে বলে

---আমার গোলাপ কই? 

----কেন সকালেই ত দিলাম মৌ এর হাতে ,

---কেন তুমি নিজে দিতে পারনি ? অদিতির সারা মনে অদ্ভুত এক আলোড়ন নিজেকে শান্ত রেখে বলে একই ত কথা আপনি ফুল চেয়েছেন আমি দিয়েছি ,

----এক কথা নয় কাল থেকে তুমি দেবে আমি নিচে নেমে হাত বাড়িয়ে নেব ।

অদিতি বলে বেশ দেব । অয়ন যায় অনিকের ঘরে একটা বই নিতে এসেছিল সে , তারপর মনে হল অদিতিকে একটু ঘাবড়ে দিই এমনি ওর সাথে দুষ্টুমি করতে বেশ লাগে ।ও খুব শান্ত আর দেখতে শ্যামলা মিষ্টি । আর খুব ভিতু ।

অদিতি আর মৌ রেডি স্কুলে যাবে অনিক চলে গেছে ওর পরীক্ষা মা বলেন অয়ন , আমার হাতে অনেক কাজ একটা রিক্সা ঠিক করে দাও ওদের , দেখো রিক্সা ওয়ালা যেন বুড়ো আর ভাল হয় ,

অয়ন হাসতে হাসতে বলে, 

----বুড়ো কি ওদের টানতে পারবে খালা ?এক এক জনের যে ওজন ।হেসে ফেলে মা বলেন

--- বাবা দুষ্টুমি রাখো দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদের ।

ওরা বেড়িয়ে পড়ে । ওদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে বড় পুকুর , এর ধার ঘেঁষে বড় বড় গাছ আর শান বাঁধানো ঘাটে সারাবেলা কেউ না কেউ গোসল করে ,কাপড় কাঁচে গল্প করে ,মোটের ওপর লোকের আনাগোনা থাকেই । গাছগুলো সুন্দর তুমুল হাওয়া দেয় পানিতে সাতার কাটে রাজ হাঁস আর হাঁস ।

পুকুর পাড়টা পেড়িয়ে একটা গলি ,ভাগ্য প্রসন্ন না হলে গলির মোড়ে না গিয়ে রিক্সা পাওয়া যায় না । ওরা গলিটা পার হওয়ার সময় দুটো বখাটে ছেলে কি যেন বলে ওদের লক্ষ্য করে অয়ন ভীষণ রেগে কিছু বলতে যায় লোকজন থামায় ওকে তবে সেও সাবধান করে দেয় কোনোদিন যেন এ পাড়ায় না দেখা যায় ওদের । এরপর অয়ন ওদের রিক্সা ঠিক করে দিয়ে সেও চলে যায় ভার্সিটিতে সে এবার প্রথম বর্ষের ছাত্র তার বিষয় গনিত ,ভীষণ রসকষহীন মনে হয় তার ।

ক্লাস শেষে বাসায় এসে অয়ন ভাবতে বসে , অদিতিকে তার শুধু ভাল না বেশ ভালো লাগে কিন্তু কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি সামনে ওর এস এস সি পরীক্ষা এসময় এই কথা বলে ওকে ভাবিয়ে তোলা ঠিক হবে না ,অথচ না বলতে পেরে সে ছটফট করে রাত দিন ।একটা ভয়ও কাজ করে যদি অদিতি ওকে না বলে ? না ওকে তেমন অপছন্দ করে বলে ত মনে হয়না। 

অদিতি খুব সরল একটা মেয়ে ছোট থেকে ওকে দেখছে ,বই পড়া আর বাগান করা এই নিয়েই মেতে থাকে সারাক্ষন । মুকুলের খুব অপছন্দ ওদের গানের মাষ্টার কে ,ওরা তিনজন মানে অদিতি মৌ আর মিমি যখন গান শিখতে বসে অয়ন খেয়াল করে দেখেছে মাষ্টার যেন অদিতির দিকে একটু বেশি মনোযোগ দেয় , আর বেছে বেছে প্রেমের গানগুলোই ওকে শেখাবে বড় রাগ হয় তার , এসময় মা খেতে ডাকেন ।

ফাগুনের এই দুপুরগুলো দুর্বিসহ! কি মন উদাস করে ...পুকুর পার থেকে আসা হাওয়া কি যেন বলতে চায় , বার্তা টা ঠিক ধরতে পারেনা অয়ন ,আমের মুকুলের গন্ধ অন্যরকম আবেশ ছড়ায় কাউকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে ,তখনই ভেসে উঠে অদিতির মুখটা । বাগানের দোলনায় নির্জন দুপুরে অদিতি যখন আনমনে দোল খায় আর কখনো কখনো গেয়ে ওঠে ' কত যে কথা ছিল কত যে ছিল গান...' মনে হয় ওর জন্যেই গানটা গাইছে ... অদিতির হাতে থাকে বই এলোমেলো চুল, কি অপরুপ যে লাগে ওকে দেখতে যেন ফুলপরী ।পথ ভুল করে থেকে গেছে যেতে পারেনি নিজের দেশে ... অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য । 

আচ্ছা অদিতি কি কিছুই বুঝতে পারেনা ওকে ? অদিতির জন্মদিনে মুকুল চুপি চুপি ওকে ছাদে ডেকে এনে গোলাপ আর প্রেমের গানের সি ডি উপহার দিল তবুও কি মেয়েটা বুঝল না ? না কি বুঝেও বুঝতে চায় না ?

লাল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে অয়ন ভাবে আর নয় কালই ওকে বলবে যদি অন্য কেউ এরই মধ্যে ওর জীবনে এসে পড়ে ।ওই গানের মাস্টারটা যদি এসে পড়ে ওদের মাঝে ? না দেরী করবে না অয়ন কিছুতেই না ।

কিছু দিন কেটে গেল নিজের নিয়মে দিন শেষে রাত নামলো বেশ কয়েকটি অমাবস্যা পুর্নিমাও এলো গেলো কিন্তু অয়নের আর বলা হোল না। অদিতির সামনে গেলেই কি এক সঙ্কোচ ঘিরে রাখে তাকে শুধু মনে হয় ওত হারিয়ে যাচ্ছে না বলা যাবে একসময় সে খুব ব্যস্ত এখন টিউশুনি আর পড়াশুনা নিয়ে । গানের প্রতি ও খুব ঝোঁক বেড়েছে খুব ।

দিন কাটতে থাকে অদিতিও ব্যস্ত পড়ালেখায় সামনে এস এস সি পরীক্ষা নষ্ট করার মতো সময় নেই গান শেখাও বন্ধ এখন বাগানটার দায়িত্ব এখন অনিকের আর মিমির । অদিতিও গাছের যত্ন করে মাঝে মধ্যে ।

পুরোদমে লেখাপড়া করছে রুটিন মেনে ।স্যার আসেন পড়িয়ে যান কোচিং যায় মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মিমি আর ভাইয়ার সাথে খুনসুটি , মিমির টিয়াটা নিয়ে দুষ্টুমি ,নিজের মতো গান করা মৌ এর সাথে গল্প এভাবেই কাটছে তার সময় , পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব মনে পড়ে অয়নের কথা ও কি এত ব্যস্ত অর মনেও পড়েনা ওর কথা ? এখনো রোজ ভোরে অদিতি বাগানে হাঁটে তারপর পড়তে বসে আর মুকুল তখন রেওয়াজ করে বারান্দায় একবারও ত তাকায় না ওর দিকে , বুক চিরে কান্না আসে অভিমান হয় না আর ভাববে না সে অয়নের কথা ।

আসলে অয়ন ঠিকই খেয়াল করে অদিতিকে কিন্তু মনে হয় অদিতি কেন নিজে থেকে একটা কথাও বলে না ? এত অহঙ্কার কিসের ? আবার এও ঠিক মুকুল ভীষণ ব্যস্ত পরীক্ষা নিয়ে এর মধ্যে ঠিক প্র্যাক্টিক্যল পরীক্ষার আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ,অথচ বসে থাকলে চলবে না অ্যায়সাইনমেন্ট তৈরি করতে হবে পেপারস রেডি করা অনেক কাজ এগিয়ে আসে বন্ধুরা সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে অন্তরা । 

মাঝে মাঝে অদিতির মুখটা খুব বেশী মনে পড়ে , সেদিন ও এসেছিল বাগানের গোলাপ নিয়ে অয়ন কে দেখতে ,কিন্তু অভিমানে অয়ন কথা বলেনি কেন এত দেরীতে এল ও ? অদিতি মুখ ভার করে চলে এসেছে ওর চোখের কোনে কান্না জমেছিল । না ওকে কাল ক্ষমা চেয়ে নেবে ভাবলও সে । কিন্তু ব্যস্ততার কারনে মনেই থাকলো না সে কথা ।

সেদিন রাতে খুব সুন্দর জ্যোৎস্না ছিল ,বাগানে হাস্নাহেনা ফুটেছে গন্ধে পাড়া মাতাল রাত তখন বারটা প্রায় অয়ন গাইছিল ' কাজলো নদীর জলে , ভরা ঢেউ উছল ছলে ...' এই গানটা, অদিতি নিজের অজান্তেই বাগানে এসে বসে মনের ভেতর তোলপাড় , মনে হয় ওর উদ্দেশেই গানটা গাইছে ্সে কাল যেভাবেই হোক ও জানাবে অয়ন কে তার ভালোবাসার কথা ।

অয়ন ভাবে অদিতি শুনতে পাচ্ছে তো ? 

এসময় বাগানে আসে অনিক ও বলে কি সুন্তুদর জ্যোৎস্না আজ তুই ও একটা গান কর নারে ? অদিতি গায় ''চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে ...' বাবা মাও এসে বসেন ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান শোনে অয়ন মৌ আর খালা খালু ।

কি সুন্দর গাইল ও বুকটা কেমন করে উঠলো অনিকের না ওকে বলতেই হবে কাল 'ভালোবাসি ' ।

এদিকে ভয়াবহ রকম দুসংবাদ অপেক্ষা করে আছে অয়ন জানত না জানলো দুদিন পর খাবার টেবিলে বাবা বললেন আমাকে রাজশাহী বদলী করা হয়েছে এ মাসেই যেতে হবে । সবাই খুব অবাক হয় অথচ করার কিছু নেই সরকারি চাকুরী বদলী করলে যেতেই হবে । মা বলেন মৌ এর জন্য ভাল স্কুল পাবো ত ? এই ক্লাস নাইনের বছরটা খুব জরুরী সময় । বাবা বলেন পাবে সরকারী স্কুলেই ওকে নিয়ে নেবে এটা নিয়ম ।এখন গুছগাছ করতে থাকো আমি আগে যাই তোমারা দুমাস পর এসো , সেভাবেই গুছগাছ চলতে থাকে ।অয়ন হলে সিট যোগার করে নেয় । দুমাস পর মৌ রা ঢাকা ছেড়ে চলে যায় । যাবার সময় খুব কান্নাকাটি করে সবাই ।

যাবার দুই দিন আগে অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে খালা বলেন ভালো করে পরীক্ষা দিশ , তুই যে আমার বউমা হবি । 

খালার কথাটা কানে বাজতে থাকে আনন্দ শিহরণ খেলে দেহ মনে । খালা আরও বলেন এত তাড়াতাড়ি বলতাম না কিন্তু বলার ত সময় পাবনা তাই বলা তোর মায়ের সাথে কথা হয়ে আছে তুই আমার ছেলের বউ হবি ,অয়ন ও জানে তোকেও বলে রাখলাম । তবে এও বলি তোর যদি এতে মত না থাকে বা অয়ন যদি মত না থাকে আমরা জোর করবো না । অয়নের সাথে কথা বলেছি খুব পছন্দ তোকে এখন তোর মত বল ? সামনে মা আর খালা দুজনেই দাঁড়িয়ে ভীষণ লজ্জা করে অদিতির ,সে অস্ফুটে বল্ে আপনাদের মতই আমার মত সেদিন থেকেই সে ভাবতে শুরু করে ওর বিয়ে হয়ে গেছে মুকুল ওর স্বামী । মনে তখন আনন্দের বন্যা । চলে গেলেন খালারা। সব কেমন খালি খালি লাগছে মৌ নেই অয়ন নেই । দুপুর বেলায় মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় খুব কান্না পায় ।

খালারা যাওয়ার পর অয়নও হল থেকে মাঝে মাঝে আসে । আগে ২/১ দিনের ছুটি হলে এসে রাতে থেকে যেত ,সেই দিনগুলো খুব আনন্দের হত সারাদইন হৈ চৈ গান । মা ভালমন্দ রান্না করতেন ,ইদানিং ও আসেনা বললেই চলে , ভাইয়ার সাথে দেখা হয় হয়ত কিন্তু ভাইয়ার কাছে জানতে চাইতে খুব লজ্জা করে অথচ কি কষ্ট যে হয় মনে মনে । অদিতির পরীক্ষা শেষ হাতে অফুরন্ত সময় । এখন অয়নের দেখা নেই । একদিন হঠাত এল সে কেমন যেন দূর দূর ভাব রাতে থাকতে খুব অনুরোধ করলো মা থাকলোনা সে ,এক সময় অদিত ও বলল আজ থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে ? অয়ন বলল হবে পড়াশুনার খুব চাপ । সে রাতে অদিতি খুব কাঁদল অয়ন এর এই '' না ''তার বুকে বিঁধে গেল কাঁটার মত ।

অয়নের মনে তখন তোলপাড় একদিকে অদিতি অন্য দিকে অন্তরা । ও অদিতিকে ভুলতে পারছেনা অন্তরাকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না বরং অন্তরার ছায়া গাঢ় হয়ে উঠছে ওর মনে । অন্তরা অদিতির চেয়ে অনেক বেশী পরিপক্ক , সাবলীল , ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে অনেক সাচ্ছন্দ বোধ করে অয়ন , অনেক বিষয় নিয়েই যা অদিতির সাথে বলা যায় না ।

অদিতি এখনো ছেলে মানুষ । লজ্জাবতী লতার মত ছুঁয়ে দিলেই নেতিয়ে পরে, যা বলে মুকুল সেটাই মেনে নেয় ভালো বলে । নিজের মতামত দিতে পারেনা ।সিদ্ধান্ত নিতে শেখেনি । ও অবুঝ । 

অন্তরা তা নয় ও সিদ্ধান্ত দিতে ও নিতে জানে অয়ঙ্কে অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেয় সে । 

অদিতি কে কথা দেওয়া আছে , এত সত্যি একসময় অদিতিকেই তার খুব আপন মনে হতো সে নিজেই তা তার মায়ের কাছে স্বীকার করেছে । কেউ তাকে জোর করেনি । আর সবচেয়ে বড় কথা অদিতি জানে ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে । এখন সে কি করবে ? ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে ওর ।

এখনো সে অন্তরাকে বলেনি অদিতির কথা আর অদিতিকে ত বলার প্রশ্নই আসেনা অন্তরার কথা বলার । আরো ভাবতে হবে তাকে ।

দিন দিন জায়গা করে নিচ্ছে অন্তরা অয়নের মনে । অন্তরার সাথেই আজ কাল অনেকটা সময় কাটে ওর ।পড়াশুনা সব কিছুতেইসে তাকে খুব সাহায্য করে ।ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে এখানে ওখানে বেড়াতে দেখা যায় । ব্যাপারটা অনিকের ও জানতে বাকী থাকে না ।কিন্তু এই মুহূর্তে সে অদিতিকে কাঁদাতে চায় না তাই ওকে কিছু বলবে না বলেই ঠিক করে ।

সেদিন একা ঘরে অনিক মা কে প্রশ্ন করে

-----কেন কথা দিয়েছিলে মা? এখন যে আমার বোনটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছ ? সে সব খুলে বলে মাকে, মা চুপ হয়ে যান একদম ,ভাবেন এ কি করলাম আমরা ? অনিক বলতে থাকে

--- ভাবলে না একবারও বড় হলে মানুষের ইচ্ছেও বদলে যেতে পারে ? ওদের নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে?

----মা বলেন ওদের ত সব জানিয়েছি । তাও অয়ন এমন করতে পারলো ?

-----অদিতি জানে কথা দেওয়া আছে ?

----সব জানে ও । 

----কেন মা ওকে জানালে ? ও নিশ্চয় অয়নকে নিয়ে ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন দেখছে , ওর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে এখন ।তুমি বুঝতে পারছ মা ? ওর এই বয়সে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট কত তীব্র হবে ?

মা চুপ করে কাঁদতে থাকেন । এখন অয়নকে ত দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই এ হল মনের ব্যাপার । রাতে অদিতির বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন ঠিক করেন ।তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন ,অদিতিকে বোঝাতে হবে ,মন ভাল রাখতে হবে ।

সেদিন থেকে অনিক খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে অদিতির প্রতি বাগানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন উদ্দমে । কলেজে ভর্তির জন্য পড়তে বলে বেড়াতে নিয়ে যায় । অদিতি সব বুঝতে পারে সে এতদিনে জেনে গেছে কি হয়েছে ?অনেক আগেই আঁচ করেছিল এখন সন্দেহমুক্ত হয়েছে কিছু প্রমান দেখে নিজেকে সে প্রস্তুত করতে থাকে একাকি থাকার জন্য ।

মায়ের অনুরোধে নিজের মুখ রক্ষার খাতিরে এখনো অয়ন কে যেতে হয় ওই বাসায় , একদিন দুপুরে অদিতি যখন এলোচুলে বাগানে দোলনায় বসে বই পড়ছিল আসলে ও কিছুই পড়ছিল না বই হাতে নিয়ে ভাবছিল ওর আগামীদিনগুলো কি করে কাটবে ? ... দুপুরের নির্জনতায় খুব মন খারাপ ছিল তার সে শুনছিল মৌমাছির গুনগুন দেখছিল প্রজাপতির উড়ে যাওয়া, দুটো শালিখ হাঁটছে শিউলি গাছের ছায়ায়। এসময় অয়ন এল গেট দিয়ে ঢুকতেই অদিতি ডাক দেয়,-এদিকে আসুন ও তাকে আপনিই বলে ,অয়ন অপরাধী মুখে থমকে দাঁড়ায় ...কাছে আসে অদিতি যায়গা করে দিয়ে

---বলে বসুন খুব সংকোচে ওর পাশে বসে অয়ন অথচ ছয় মাস আগেই এই সংকোচ ছিল না তার । 

একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নেয় অদিতি তারপর বলে এত ভাবছেন কেন বলুন তো ? আপনার অন্য কাওকে ভাল লেগেছে লাগতেই পারে তার জন্য এত দ্বিধা কেন ? আপনি আমাকে বললেই তো মিটে যায় সব । আপনি মুক্ত মানুষ ,আমি ত আপনাকে কোনদিন কথা দিই নি বলিনি ভালোবাসি তাহলে কিসের বন্ধন আপনার ? যাকে ভাল লেগেছে তার কাছে ফিরে যান ...বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে মুকুল প্রশ্ন করে তুমি জানলে কি করে ? 

---সেটা কোন দরকারি বিষয় নয় যা দরকারি ছিল বলেছি । 

---না তবুও বল কি করে জানলে ? আর তুমি কি করে এভাবে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি জানোনা আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ।

----জানি সব জানি কিন্তু জোর করে পেতে চাইনা । কথা দিয়েছিলেন আমাদের দুজনের বাবা -মা তাই না । আজ আপনার একজন কে ভালো লেগেছে ,কাল আমার খেত্রেও এটা হতে পারে তাই এ কথা দেয়া নেয়ার মূল্য আর নেই ।

-----তুমি বড়দের মত করে ভাবতে শিখলে কবে অদিতি ?এভাবে দুই মিনিটে সমাস্যার সমাধান করে দিলে , কষ্ট হল না তোমার? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব কষ্ট পাবে এসব শুনলে ।

-----না হল না কষ্ট .. আর এসব কথা কি লুকিয়ে রাখা যায় ?.ভাবনার কথা বলছেন ? পরিস্থিতি আমাকে এভাবে ভাবিয়েছে ,আপনি যতটা অবুঝ ভাবেন আমি তত অবুঝ নই অয়ন । কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ ও নেই আপনি ভেতরে যান মা আছেন । 

--- আচ্ছা এখন বল তুমি কি করে জানলে ?

-----বলতেই হবে ? তবে শুনুন সেদিন আপনি একটা খাতা ফেলে গিয়েছিলেন সেখানে লেখা ছিল আপনার এই ভাললাগার আর দ্বিধা দন্দের কিছু কথা । আর আপনার আচরণেই ত প্রকাশ পাচ্ছিল আপনার দ্বিধার কথা , ইদানিং খুব এড়িয়ে চলছিলেন আমাকে যাই হোক , খাতাটা আমি রেখে দিয়েছি নিয়ে যাবেন আজ ।আর খালা খালুকে বলবেন এই বিয়েতে আমি রাজি নই তাহলেই মিটে যাবে সব ।

----বেশ তাই হবে বলে উঠে যায় অয়ন তার বুকের ভেতর কেমন এক দুঃখ ভর করে , আর অদিতি তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ...

বাগানে শিউলি গাছের ছায়ায় এতক্ষন দুটো শালিখ ছিল এখন একটা একা মনের সুখে ঘুরছে ।অদিতি ভাবে আজ থেকে আমিও ওর মতো একাই উড়বো মনের আকাশে ............

অনেক বছর পর অদিতি তখন ডাক্তারি পাশ করে চাকরী করছে এতদিনে মিমি কলেজে পড়ছে মৌ এর বিয়ে হয়েছে সে বিদেশে থাকে বরের সাথে । অদিতির দেখা হল অয়নের সাথে এয়ারপোর্টে অদিতি বড় ডিগ্রী নিতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড আর অয়ন যাচ্ছে অফিসের কাজে সে বেশীর ভাগ সময় ওই দেশেই থাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসে ওরা থমকে দাঁড়ায় ,অয়নের চুলগুলো সাদা , চালচলনে বেশ ভারিক্কি ভাব , বলে 

----কেমন আছ অদিতি ?

-----ভালো ।আপনি একা যে ?

---তুমিও ত একা ?

আমিত সবসময় একাই ছিলাম একাই আছি কিন্তু আপনি একা কেন ?

---- অন্তরা নেই ।আমাদের প্রথম সন্তান জন্মদিতে গিয়ে মারা গেছে ...

---মেয়ে কোথায় থাকে কেমন আছে ? বয়স কত ?

---বলছি দাঁড়াও মেয়ে এতিম খানায় মা মারা যাবার পর ওকে দেখার কেউ ছিল না বয়স ৩ বছর ।

----কেন ওর নানা - নানু নেই?

---না তারা এই বিয়ে মেনে নেননি ওর সন্তানের দায়ভার কেন নেবেন ? আমিই বা কেন দেব?

---তাই বলে এতিম খানায় বড় হবে ও ?

--- হা উপায় কি বল ?অনুর যে কেউ নেই আর । আমি থাকি ব্যস্ত কে দেখবে ওকে ? মৌ টাও বিদেশে ।একবার মনে হয়েছিল তোমার কাছে যাই পরে ভাবলাম কোন মুখে যাবো ? আজ আরও অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে তুমি বিয়েই করলে না । আমার জন্য তোমার জীবন ও নষ্ট হল।

কোন কথা বলল না অদিতি শুধু মনে মনে ভাবল বিয়েত হয়েছিল সেই ছোট বেলায় আর ভেঙেও গেল তখনি । 

পুরো জার্নিতে অদিতি কোন কথা বলল না ।

প্লেন ল্যান্ড করবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইক্রোফোনে তার ঘোষণা আসছে সিট বেল বাঁধতে বলা হচ্ছে ,

--- তখন অদিতি বলে একটা কথা রাখবেন ?

---কি বল ? আমার কিছুই করার মুখ নেই আর ...তবুও যদি থাকে রাখব অবশ্যই বল তুমি ।কিছুক্ষন চুপ থেকে অদিতি বলে ,

------অনুকে দেবেন ? 

-------মানে ? তুমি কি বলছ ? 

---- হা আমিও বড় একা , আমি ওর দায়িত্ব নেব মানুষ করবো ।ও জানবে আমি ওর খালা । ওর কোন অযত্ন হবে না এখনো মা আছেন ,আমরা দুজনে ঠিক ওকে দেখে রাখবো ।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অয়ন বলে বেশ তাই হবে ,ফিরে এসে ওকে তোমাদের ওখানে রেখে আসবো ,তোমার কাছে আমি হেরে গেলাম চিরকাল । ওর চোখে ভেসে ওঠেচোখের সামনে ক্ষতবিক্ষত ফুলটা ভেসে ওঠে ।

অদিতি মনে মনে বলে তোমার জন্যই আমার ঘর বাঁধা হোল না সংসার করা হোল না মা ডাক শোনা হোল না , জগতের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কাছে আমি কবেই হেরে বসে আছি চোখের সামনে সূর্যমুখীর বুক থেকে উড়ে যাওয়া সেই টিয়ে পাখির ছবিটা... 

প্লেন তখন লন্ডনের মাটি স্পর্শ করল মাত্র ।

ঢাকা ।