মৌ দাশগুপ্তা










আমি ও নারীবাদ





সময়টা আন্দাজ 2002, আমি তখন একাধারে NIT তে পড়ছি ও পড়াচ্ছি। সবে 2nd সেমিস্টার শেষ হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের ভীড় নেই, আড্ডার মেজাজে পরীক্ষার খাতা দেখা চলছে। ইনঅরগ্যানিক ল্যাবের দেওয়াল ঘেঁষা বড় টেবিলটা ঘিরে আমাদের মজলিস চলছিল। টেবিলে আমার ঠিক উল্টোদিকে বসেছিলেন সদ্য “লিমকা বুক অব রেকর্ডস”-এ নাম তোলা ফিজিক্সের প্রফেসর ডক্টর টি.এন.তেওয়ারী। অসম্ভব ভালো স্কলার ও ডাকসাইটে মিতব্যায়ী। ওনার এই মিতব্যায়িতা প্রসঙ্গেই স্যার বলছিলেন, ঘরের বা বাইরের লোকেরা স্যারকে কিপ্টে বললেও আদতে উনি সারাজীবন সঞ্চয় করে যাচ্ছেন ওনার বাবার নামে একটা রিসার্চ ইন্সটিচিউট খুলবেন বলে। ম্যাথামেটিক্সের জনৈক বয়স্ক প্রফেসর, ( নাম বলাটা উচিত নয়, তাই উহ্য রাখলাম), তাই শুনে বললেন, অতীতে ইনভেস্টমেন্ট করে লাভ নেই। উনি সঞ্চয়ের সিংহভাগটাই তাই রেখেছেন ছেলের পড়াশুনো আর মেয়ের বিয়ের জন্য। শুনে আমি একটি নিরীহ প্রশ্ন রেখেছিলাম, 
- মেয়েকে আর পড়াবেন না স্যার? 
- মেয়েদের বেশী পড়িয়ে আর কি হবে? এই তোমার মত নারীবাদের ধ্বজাধারী তৈরী হবে। সমাজ সংসার সব উচ্ছন্নে যাবে।
বয়স্ক লোকের সম্মান রেখে তখনকার মত চুপ করে গেলাম। কি ভয়ংকর উপমা! “নারীবাদের ধ্বজাধারী”, (কেন বলেছিলেন সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর,তাই বলছি না,) তবে আমি কিন্তু ‘মানুষ’ বা ‘মেয়েমানুষ’, দুই পরিচয়েই সমান খুশী। বরঞ্চ সাজতে গুজতে, গুছিয়ে চুল বাঁধতে, লোকের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে, অল্পবিস্তর PNPC করতে, টক- ঝাল আচার খেতে, মান-অভিমান, রাগ-বিরাগ, হিংসা-ভালোবাসা নিয়ে ঘর করতে, আমি একজন পুরোদস্তুর নারী , আর এই পরিচয়টা আমি খুব ভালোওবাসি, কিন্তু নারীবাদ ? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে পড়েছি বটে, কিন্তু সম্যক ধারণা নেই। জিনিষটা ঠিক কি? খায় না মাথায় দেয়? একটু দেখা যাক।
প্রথমেই সর্বজ্ঞানের ভান্ডার ‘গুগল’ কি বলে দেখা যাক।
“নারীবাদ (ইংরেজি: Feminism) নারীদের অধিকার আদায়, সমতা অর্জন এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আন্দোলনকে নির্দেশ করে। এখানে অধিকার আদায় এবং অংশগ্রহণ বলতে আইনী সুরক্ষা প্রদান, রাজনীতি, ব্যবসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদান এবং নারীর ক্ষমতায়নকে বুঝায়। নারীবাদ ধারণাটি নারীর অধিকার ধারণাটির সাথে সংযুক্ত। নারীবাদ প্রথাগত নানা ধারণাকে অস্বীকার করে বিশেষত নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে। নারীবাদী হতে পারেন যে কোন লিঙ্গের বা শুধুমাত্র একজন নারী , (এই ক্ষেত্রে পুরুষরা হবে profeminist) যিনি নারীবাদে বিশ্বাস করেন।“
ভীষণ শক্ত শক্ত কথা। সাজানো গোছানো ব্যাখা। অতএব আরেকটু পড়াশুনো করে দেখা যাক আমার মোটা মাথায় জ্ঞানের আলোকশিখা কতোটা জঞ্জাল সরাতে পারে। দেখতে গিয়ে যা যা বুঝলাম সেটাই এবার একটু সবিস্তারে বলি।

একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকারের দাবি হলো নারীবাদ । 
আধুনিক সংজ্ঞায় নারীবাদ হচ্ছে পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীর মর্যাদাহীনতা সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন এবং এই       অবস্থার পরিবর্তনে নারী ও পুরুষের সচেতন ও সক্রিয় উদ্যোগ।
বিশ্বজুড়ে যে বিদ্যমান শ্রম বিভাগ পুরুষদের ওপর রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এসব সামাজিক পরিমণ্ডলের দায়িত্ব অর্পণ করে এবং নারীকে গোটা সংসারের বোঝা বহনকারী বিনা মজুরির বাঁদিগিরির দিকে ঠেলে দেয় তাকে চ্যালেঞ্জ করে ‘নারীবাদ’। 
নারীবাদ হলো একটি সামাজিক আন্দোলন যা নারীর গৎবাধা ভূমিকা ও ভাবমূর্তির পরিবর্তন, লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপ এবং সমজে নারীর সমান অধিকার অর্জনের প্রয়াস। অনেকে ভ্রান্ত ধারণার বশে নারীবাদকে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব বা পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রাধান্য স্থাপন বলে মনে করে। পিতৃতন্ত্রের ঠিক বিপরীত কোনো কিছু বলে বিবেচনা করে নারীবাদকে। কিন্তু নারীবাদ অর্থ কখনই নারীর প্রাধান্য বিস্তার নয়। নারীবাদ তাই নারীদের আন্দোলন নয়, বরং নারীদের জন্য আন্দোলন, নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সে জন্য তা নারীদের পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশী মানুষেরও আন্দোলন।
এবার দেখি, এই ‘নারীবাদ’ শব্দটির বুৎপত্তি কোথায়? ফরাসী শব্দ ‘ফেমিনিজম’ বা বাংলায় ‘নারীবাদ’ শব্দটি প্রথম প্রচলন ও ব্যবহার করেন কাল্পনিক বা ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুয়েরার। ১৮৯৪ সালে ইংরেজী শব্দটি গৃহীত হলেও ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড অভিধানের পরিশিষ্টতে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়; আভিধানিক অর্থে নারীবাদ হলো একটি আন্দোলন যা, 'নারীদের সমান অধিকারের দাবি করে।' সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তাই নারীবাদ হলো পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীর ওপর শোষণ-নিপীড়ন সম্বন্ধে সচেতনতা এবং এই অবস্থা বদলের লক্ষ্যে নারীর সচেতন প্রয়াস।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, 

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।“

কিন্তু নারী যে মানব সভ্যতার অর্ধেক অংশীদার তা মানতে নারাজ পুরুষশাসিত সমাজ। যে শিশুটি মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করে, জন্মের পর থেকে তাকে কপালে টিপ দিয়ে, কানে দুল পরিয়ে, হাতে একটি পুতুল দিয়ে বলা হয় সে মেয়ে। তার পোশাকে, চলনে, বলনে প্রমাণ করা হয় সে নারী। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরা ভাবে নারী মানেই পুরুষের ভোগের বস্তু, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, সংসারের দাস। বাংলা সাহিত্যের নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধ ‘জাগো গো ভগিনী’ তে বেগম রোকেয়া বলেছেন, “স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন বালিশের ওয়্যারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধুমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল, ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন।”

একটু আগে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উদাহরন দিলাম। তাই অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও আরেকটু লিখি? রবীন্দ্রনাথের মানসী’ কবিতার নারীকে দিয়েই লিখতে শুরু করি।

“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে। বসি কবি গন
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
…………………………
…………………………
লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে দিয়ে আবরণ
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন
পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা।।”

এ কবিতায় পুরুষ নারীর ২য় বিধাতা। যে পুরুষ অনেক বেশি শক্তিশালী প্রথম বিধাতা থেকে। ১ম টি নারী সৃষ্টির কারণ, ২য় টি নারীর বন্দিত্বের কারণ। কবিতায় পুরুষ সক্রিয় নারী নিষ্ক্রিয়, নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি সম্ভোগ সামগ্রী! শেষে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্র চিন্তার অসম্পূর্নতা, যেখানে নারীর পূর্ণ অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হলো ‘অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা’ য়।

প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে নারীরা অবহেলিত।পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করলে যে ধরনের সমাদর পায় একজন নতুন মা , কন্যা সন্তান প্রসবের পরে ততোটাই ধিক্কৃত হতে হয় । অথচ কন্যা হোক পুত্র হোক জন্ম দেবার জন্যে দায়ী পুরুষের ই , x-y ক্রমজম নারীর কিন্তু নেই, নারীর কেবল xx যখন নারী x পুরুষের x মিলিত হয় তখন জন্ম নেয় কন্যা সন্তান। নারীর কিন্তু নেই কোন y. আর পুরুষের y এবং নারীর x মিলিত হয় তখন জন্ম গ্রহন করে পুত্র সন্তান । সমগ্র প্রক্রিয়াটা তো মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত নয় । এখানে কাউকেই দায়ী করা উচিত না। তবু মেয়ে সন্তান জন্মদানের অপরাধে ঐ মেয়ের স্বামীকে আর একটা বিয়ে করার জন্যে প্ররোচিত করতে থাকে তার মা , ভগ্নী ( তারাও কিন্তু নারী ) এক জন নারী হয়ে নারীর কষ্ট অনুধাবন করেনা তারা । 

বিভিন্ন ধর্মের বিধান ঘাটলে দেখা যায় , পুরুষের চাইতে নারীর স্থান কেবল নীচেই না , নারীর সব ক্ষেত্রে নিষেধের বেড়াজাল । এই বিভেদ বা বিভাজন তা পৌ্রানিক ধর্ম , হিন্দু , বা মুসলিম সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য । শুধু ব্যাক্তিগত মালিকানাই নয়, এমন কি রাজনীতিতেও রয়েছে ভেদাভেদ। আজো বন্ধ হয়নি ধর্ষন নামক পৈ্শাচিক নির্যাতন । স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি বাড়ী ফিরে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করছে । প্রতিনিয়ত তথাকথিত মামা , কাকা জ্যাঠা নামধারি কতো পুরুষের হাতে কিশোরী মেয়েরা কোণো না কোনো ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে । আভ্যন্তরিন এ সব অত্যাচারের কটা খবরই বা আসে । মেয়েগুলো লজ্জায় ভয়ে মুখ ফুটে কাওকে কিছু বলতে পারে না , পাছে তাকে না আবার পাপী ,নষ্টা ,অ-সতী ,কুলটা শব্দে ভুষিত হতে হয় ।

‘নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি ‘নষ্ট’ বলতে ভালবাসি। …নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত‘নষ্ট হওয়া’। ‘নষ্ট’ না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকারের সুস্থ ও মেধাবী মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে।’
‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ তসলিমা নাসরিনের লেখা একটি বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত বই। সেই বইটির মুখবন্ধে এই কথাগুলি তিনি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন – মানুষকে মানবতার আলোয় নতুন করে মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করার জন্য। লিখেছিলেন সেই আদিম পুরুষপ্রধান পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে লক্ষ্য করে। লিখেছিলেন একটি সুন্দর, সুস্থ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, যে সমাজ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট নয়। যে সমাজে নারীর মূল্য তার রূপ দিয়েই নির্ধারিত হবে না, নির্ধারিত হবে তার বিদ্যায়, গুণে, প্রেমে, উন্নতস্পর্দ্ধীমনে, দুঃসাহসিকতায়, সত্যনিষ্ঠায় আর সৃজনীশক্তির যথার্থমূল্যে।

তাইতো তিনি বলেন, ‘আমরা নারীরা আজ কাকে কী করে বলবো যে আমরা ভাল নেই! হাজার বছর ধরে পিঠে কালশিটে, চোখ নির্ঘুম, হাজার বছর থেকে আমরা ভাষাহীন। নারীর কণ্ঠে এবার ভাষা উঠে আসুক, স্ফুলিঙ্গ হোক সে, আগুনের মত ছড়িয়ে যাক সবখানে। নারীরা পুড়ে পুড়ে ইস্পাত হোক, নারী শক্তিময়ী হোক।’
নারীশক্তির এই জাগরন ই ‘নারীবাদ’।

 নারীবাদে অসংখ্য ‘নারীবাদ’র বেশ কিছু ধারা বা উপধারা আছে। কিন্তু তিনটি শ্রেণী ভাগ মুখ্য। এগুলো হলো-

১) উদার নারীবাদ (LIBERAL FEMINISM)
২) চরম নারীবাদ (RADICAL FEMINISM)
৩) সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (SOCIALIST AND MARXIST FEMINISM)

উদার নারীবাদ (LIBERAL FEMINISM) রাজনৈতিক এবং আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতা বিধান করার কথা বলে। উদার নারীবাদ মূলতঃ নারীদেরকে তাদের সামর্থ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীদের সমানাধিকার অর্জনের কথা বলে। উদার নারীবাদ মনে করে নারীদেরই বৈষম্য দূর করার সামর্থ্য আছে। এর জন্য সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করার প্রয়োজন নাই। উদার নারীবাদ ইস্যূ ভিত্তিক আন্দোলনের কথা বলে। নারীনির্যাতন প্রতিরোধ, কন্যা শিশুর সুষ্ঠু লালন পালন, নারীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা, ও খাদ্য অনুশীলনে গুণগত পরিবর্তন হল উদারনৈতিক নারীবাদের কতিপয় ইস্যু।

চরম নারীবাদ (REDICAL FEMINISM) মূলতঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে ঘৃণা করে। এরা সমাজ কাঠামোকে আমূল পরিপর্তনে আগ্রহী। তারা মনে করে নারী তখনই মুক্তি পাবে যখন পুরুষতান্ত্রিক ও শক্তি কৈন্দ্রিক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা কে ধ্বংস করা হবে। চরম নারীবাদীরা মনে করে সমাজ আংশিক পরিবর্তন বা সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের সমানাধিকার অর্জন সম্ভব নয়। তাদের মতে বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করার মাধ্যমেই নারী তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম। চরম নারীবাদে বেশ কিছু শাখা বা ধারা লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হল -

সংস্কৃতি ও আচরণ গত নারীবাদ, 
বিচ্ছিন্নতাবাদী নারীবাদ, 
যৌনতাবিরধী নারীবাদ। 

সংস্কৃতিবাদী নারীবাদ মূলতঃ নারী চরিত্র ও তাদের মৌলিক গুনাবলীকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই ধারার নারীবাদীরা মনে করে নারীর দৈহিক দুর্বলতা নয় বরং নারীদের দৈনন্দিন আচার ও পারিবারিক কাজকর্মকে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্বহীন এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্য দেওয়ার প্রবনতাই মূলতঃ নারী বৈষম্যের মূল কারণ। এই ধারা নারীদের বর্তমান সামাজিক দায়বদ্ধতা হতে বেরিয়ে এসে নিজেদের আচরণ পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব দেয়। 

বিচ্ছিণ্ণতাবাদী নারীবাদীরা মূলতঃ নারীপুরুষের পারস্পরিক যৌন সম্পর্ক কে অস্বীকার করে। তারা মনে করে নারী পুরুষের যৌনগত পার্থক্য কখনো সমাধান করা যাবে না। তারা মনে করে পুরুষ কখনো নারীদের সমানাধিকার দেবেনা। কারণ এতে পুরুষদের তাদের অধিকৃত কিছু শক্তি ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু পুরুষ তাদের একচ্ছ্বত্র শক্তি ত্যাগে ইতিবাচক সাড়া দেবেনা। 
চরমপন্থীদের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চাকাঙ্খী অংশটি মাতৃত্বের দায় নিতে অস্বীকার করে। তারা মনে করে মানব জাতি রক্ষার দায় শুধু নারীরা কেন নেবে? এ দায় পুরুষদেরকেও সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে। মাতৃগর্ভ ব্যতীত অন্যকোনো পন্থা শিশু জন্ম দিতে হবে। তারা এমনকি শুধুমাত্র নারীদেরকে নিয়ে পরিবার গঠনের কথা বলে।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (SOCIALIST AND MARXIST FEMINISM) নারী বৈষম্যকে মার্ক্সের তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করে থাকে।সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ মনে করে নারী বৈষম্যের মূলকারণ হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যা নারীদের অবমুল্যায়ন করছে। বর্তমান সমাজ নারীকে পণ্য এবং সন্তান উপাদনের যন্ত্র মনে করে। তারা মনে করে ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যে রাষ্ট্রকাঠমো তৈরি করেছে তা শক্তি কেন্দ্রিক। আর সমাজের প্রতিষ্ঠিত শক্তি মানে পুরুষ সমস্ত দ্রব্য ও সেবা কে নিজের জন্য ব্যবহার করছে। আর এভাবেই সমাজের অন্যান্য দ্রব্যের মত নারীও পুরুষদের অধিকার চলে গেছে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ মূলতঃ রাষ্ট্রীয়কাঠামোর ভিতরে নারীবৈষম্যকে দেখে।

আসলে নারীর প্রতি বৈষম্যের মুলে হলো পুরুষের দৈহিক ক্ষমতা নারীর থেকে বেশী হওয়ার কারনে, গায়ের জোর যার মুল্লুক তার।আজ দেশের নারীশক্তি সাম্প্রদায়িক ভেদভাব ভুলে সেবায়, আদর্শে, দেশ শাসনে, অফিস, আদালতেও নিজের ভূমিকা রাখছে। তারা কর্মব্যস্ত পুরুষের সাথে সমান দক্ষতায় ও ব্যস্ততায় কর্মজগতে এগিয়ে এসেছে। নির্মাণ কাজে নারী শ্রমিকের ভূমিকা রয়েছে। শিল্প-সঙ্গীত, নৃত্য, শিক্ষা কেন্দ্রেও নারী সুন্দরকে বিকশিত করে তুলছে। যুদ্ধবিদ্যা, এভারেস্ট জয়ে, মহাশূন্য বিজ্ঞানে নারীদের অবদান রয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা-দীক্ষায়, বুদ্ধিমত্তায়, মননশীলতায় কোন অংশেই নারী কম যায়না। নারীর অন্তরনিহিত শক্তিকে চিনে নিতে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যে কত আবশ্যক তা ভাষায় বোঝানো কষ্টকর। একজন সুশিক্ষিত মা দিতে পারেন একটি সুন্দর সমাজ। 

বাংলা সাহিত্যের নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধ ‘জাগো গো ভগিনী’ তে লেখিকা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাই নারী জাগরণের মূলমন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নারীর প্রকৃত শিক্ষাকে। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই একজন নারীর অনগ্রসরতা দূর করে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর প্রভাব সম্বন্ধে নেপোলিয়ান বলেছেন- ‘‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’’ একথায় নারীবাদের উদ্দেশ্য হলো নারীকে শিক্ষা অর্জন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর করা তা হলে আপনাতেই সমাজে নারী তার জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে। আর এটা প্রতিটা নারীকেই সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। নারীর সম্ভাবনার শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তাই নারীকে অবহেলা না করে বরং সম্মান দেখাতে হবে। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্ধেক জনশক্তিকে তথা নারীদের সহযোগিতা করলেই দেশ ও জাতি অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।

পরিশেষে একটি ছোট্ট কথা। আমি আমার নারীশক্তি নিয়ে কোন বাদ বিবাদে যেতে রাজী নই। তাই আমি নারীবাদী কি নারীবাদী নই, সেটা পুরোপরি গৌণ, তবে এ টুকু বলতে পারি যে আমি ‘নারী’ হয়েই গর্বিতা।


কলকাতা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.