
'বিশ্ব-মানবতাবাদ ও রবীন্দ্রনাথ'
সর্বভারতীয় উপমহাদেশের দার্শনিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কালোত্তীর্ণ অবস্থান নিয়ে
বিরাজমান। সাহিত্য ও মানবসভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন শৈল্পিক শাখায় অসাধারন প্রতিভা গুনেই কবি রবীন্দ্রনাথের মানসে উল্লেখিত সৃজনশীল ধারা সমূহের যুগপত উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের মানুষ, তাঁর রচনা তত্ত্বনির্ভর নয় অর্থাৎ বিশুদ্ধ দর্শনে আমরা যেমন পৃথিবীর নানা জিজ্ঞাসার দর্শনসম্মত আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা দেখতে পাই, সত্য উপলব্ধিতে যেমন মানদণ্ড নির্ভর আলোচনা দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের রচনায় তত্ত্বগত প্রয়াস হয়ত তেমন ভাবে পাওয়া যায় না। তাই অনুভব সমৃদ্ধজ্ঞান যখন কোন রচনায় পরিস্ফুট হয় তখন তাতে মিশ্রণ থাকে রূপ, রস আর নান্দনিক ছোঁয়ার, এজন্য সমগ্র রবীন্দ্রদর্শন এক অখণ্ডতাকে নির্দেশ করে। যা দর্শনের ভাষায় রহস্যবাদ নামে পরিচিত।
রবীন্দ্র-দর্শনে বিশ্বতত্ত্বের যে দর্শন প্রকাশিত তাঁর ভিত্তি বেদ ও উপনিষদ। রবীন্দ্র দর্শনে বেদের প্রভাব সম্পর্কে রওশন আরা ‘বেদান্ত দর্শন ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলেন, আশৈশব উপনিষদের প্রভাবে লালিত যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন সাধনা ছিল নিখিল দেবতার ধ্রুপদের সাথে মাটির মানুষের জীবনের গান মেলানো। বেদান্ত দর্শন কবির জীবনের মর্মমূলে রস সঞ্জীবিত করে এক আধ্যাত্ম অনুভুতির জগতে নিয়ে গেলেও বিশ্বকবির স্বকীয় অনুভবের স্পর্শে আত্মা, পরমাত্মা ও জগতের বৈচিত্র্য ভিন্ন মাত্রার দর্শনে রূপ নিয়েছে। বাইরের যে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতিজগত, সকল ক্ষুদ্র জীবাত্মা তা ঐ অসীম সত্তার বহু রূপ নামরূপের চিরাচরিত প্রকাশ। কবির ভাষায়-
“জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্র রূপিণী।
অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে
আকুল পুলকে উলসিছ ফুল কাননে,
দ্যুলোক ভূলোকে বিলসিছ চল চরণে
তুমি চঞ্চল গামিনী।”
নিখিল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, বিশ্বের অন্তর্গত সমস্ত কিছু দিব্য চেতনারই প্রকাশ। ব্রহ্মই পর্বে-পর্বে নব পর্যায়ে, মন প্রাণ জড় ও চেতনা রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। জগতে সকল কিছু রূপ পরিবর্তন করে পরবর্তী রূপ লাভ করেছে এবং এই পরিবর্তনের ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিটা পরিবর্তনের পরিণাম উন্নততর চেতনা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ বেদান্ত দর্শনের জগতের মায়াবাদী ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন নি। জগতের জ্ঞান মায়া, ভ্রম বা অধ্যাস নয়। জগতে যা কিছু আসে ধুলি কণা থেকে শুরু করে তরুলতা, জীবজন্তু, পশু-পাখি, পাহাড় পর্বত সব কিছুর মাঝেই ব্রহ্ম বিকশিত হচ্ছে। প্রকৃতি জগতকে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন লীলাভূমি হিসাবে, রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম জীবন ও জগতের বহুত্বের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করে বিচিত্র রূপণী হয়ে নিখিলের আনন্দ সত্যে অংশ গ্রহণ করেছে।
রবীন্দ্র দর্শনে মানবসত্তার দ্বৈত রূপের কথা বলা হয়েছে প্রতিটি মানুষের মধ্যে একদিকে আছে তাঁর ব্যক্তি সত্তার দিক, ইতিপূর্বে যাকে আমরা ক্ষুদ্র আমি বা অহং বলেছি। মানবত্মার চারিপাশে রচনা করে জাগতিক বন্ধন। সেই বন্ধন থেকে মুক্তিকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- মোক্ষ। তিনি মৃত্যুকে পরম আপনার বলে আবিষ্কার করেছেন, সে ভয়ের বিষয় নয়- মরনকে আলিঙ্গন করার জন্য মরনের হাত ধরতে কবি প্রতিটি ব্যক্তি সত্তাকে আহ্বান করেছেন। তাঁর মৃত্যু ভাবনা বিভিন্ন কবিতা প্রবন্ধে নানা ভাবে উঠে এসেছে- মৃত্যু ইতিবাচক।
সত্য সুন্দর শিবের পূজারী কবি রবীন্দ্রনাথ। জগতে ব্রম্মের লীলা তাঁর উপলব্ধিতে আনন্দ রূপে প্রতিভাত হয়ছে। কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথের নিকট মৃত্যু ধরা দিয়েছে পরম আপনার হিসেবে। তাই তিনি বলেছেন- “মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান” । পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন নয় এ জীবনতো মরণের সমষ্টি ভিন্ন অন্য কিছু নয় প্রতিপলে মানব জীবনে কত পরিবর্তন ঘটে, যৌবনের পর বার্ধক্য এ যেন এক মরণ খেলা একই মৃত্যুর শৃঙ্খল পরস্পরা। একটি মহাযাত্রা পথ মৃত্যু পথ। কবি বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টির ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ তাই আমরা মরণকে ভয় করি, আমরা ভাবি মৃত্যু বুঝি জীবনের শেষ। কিন্তু দেহটাই আমাদের বর্তমানের সমাপ্ত, জীবনটা একটা চঞ্চল অসমাপ্তি, তাহার সংগে লাগিয়া আছে, তাহাকে বৃহৎ ভবিষ্যতের দিকে বহন করিয়া লইয়া চলিয়াছে।’
মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়, এ কথাটার ওপর পিঠে আছে জীবনের প্রতি মানুষের ভালবাসা। জীবনে মানুষ নিশ্চয়ই এমন অমৃত স্বাদ পেয়েছে যা আর হারাতে রাজী নয়। এ কথাটা বিশ্বাস করে রবীন্দ্র-দর্শন।
“মানুষের ধর্ম” নামক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মানুষের দৈহিক বৃত্তি ও মনোবৃত্তি মনজাগতিক বিশ্লেষণ করে এর প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, স্বার্থ আমাদের যে সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাঁর মূল প্রেরণা দেখি জীব প্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম। কবি হিসাবেই রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি সমাধিক। তাঁর কাব্যে হৃদয়ের আবেগময় উপলব্ধি প্রকাশ করে গেছেন কাব্যে, গানে নানাভাবে। আর যারা রবীন্দ্র-সাহিত্য সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন যে কবির এই উপলব্ধি তথা সমস্ত রচনাবলী কবির নিজস্ব ‘জীবনবোধ’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই জীবন বোধই রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শন।
জাগতিক বৈচিত্রের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেছেন একটি সার্বজনীন নিয়ম রূপে। বিশ্বের গ্রহ উপগ্রহ বস্তুরাজির প্রচণ্ড গতি এবং পরিবর্তনের মধ্যে একটি গানিতিক নিয়মের বন্ধনরূপে তিনি সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলেছেন। এই নিয়মকে জেনে জ্ঞানরূপে আনন্দরূপে তাকে লাভ করাই মনুষ্য জীবনের সাধনা বলে তিনি মনে করতেন। ব্যক্তি জীবনের বিশ্বমানবিকতা অর্জনই রবীন্দ্র দর্শনের মূল কথা। আর এর পথ হিসেবে জ্ঞানের সাথে কর্ম ও প্রেমের যোগ করেছেন তিনি।
বরিশাল ।
জিনাতের প্রবন্ধে সমগ্র রবীন্দ্রনাথের নির্যাসটুকু স্বল্প পরিসরের সীমাবদ্ধতার মাঝেও স্পষ্ট ভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছে!
উত্তরমুছুনপাঠক এই লেখায় ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের দর্শনভূমির আভাস পাবেন!
সুচিন্তিত মতামত দিন