
'' সময় ''
আমার জীবন ছড়াতে ছড়াতেএসেছি এখানে
আমি কিছুই রাখিনিকুড়াইনি
তার একটিও ছেঁড়া পাতা
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো,
সব সুখ-দুঃখ,আনন্দ-বেদনা,
আমি এই হারানো জীবন আর খুঁজিনিসেই ফেলে আসা পথে।
.jpg)
ফোনটা রিসিভ করে অই প্রান্ত থেকে ভরাট কণ্ঠে কেউ বলে
কেমন আছো ?
---কে বলছেন ?
---চিনতে পারছনা মিলি ? আমি মাহিন এবার মনে পড়েছে ? বুক ঠেলে উঠে আসা কান্না চেপে মিলি বলে
---এতদিন পর ?কেমন আছেন , আমি একটু ব্যস্ত পরে কথা হবে । পরেই বা কি কথা হবে তা আর ভাবতে পারেনা সে ।এ সময় কথা ডেকে ওঠে মা -মনি আজ কিন্তু অনেক দেরী হবে তাড়াতাড়ি করো , আসছিরে বলে মিলি টেবিলে আসে দেখে নাস্তা সাজিয়ে বসে আছে শরিফা চা নিয়ে আসার আয়জন করছে , আজ চা খাবার সময় নেই । শরিফা দরজা বন্ধ করে সাবধানে থাকিস বলে কথাকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে মিলি ।
আজ রিক্সা ও ওদিকে যেতে চাচ্ছে না কি জ্বালা ! যাক একটা পাওয়া গেল দুজনে উঠে পরে চটপট রাস্তায় সব অফিস কিংবা স্কুল কলেজের যাত্রি । মেয়েকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিতেই ভাবনারা এসে ভর করে এতদিন পর কোত্থেকে এলো কেন এলো মাহিন ?
ভালোই ত ছিল সে এতদিন ,কথাকে নিয়ে একা এক জগতে । কত দুর্ভাগ্যের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে ।
আজ খুব মনে পড়ছে সেদিনের কথা ,বাবা মারা গেলেন ,ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেল , বাড়ি থেকে ভাই বোনেরা চাপ দিতে লাগলো বিয়ের জন্য , পরীক্ষার কথা বলে কিছুদিন মিলি সবাইকে চুপ রাখলো ,এদিকে ছোট বোন মৌ তখন মা হতে চলেছে পরীক্ষাও শেষ , সে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে ।
তখন সবাইতোড়জোড় করে আবার পাত্র দেখতে লাগলো মিলেও গেল ভাল পাত্র ,মিলি তো কোন দিকে কিছুর কমতি ছিল না রুপ না গুন । মা এসে বললেন এবারে আর না করিশ না মিলি বিয়েতে রাজী হয়ে যা '' মিলি বলল মা তুমিত জানো মাহিনের কথা একটু সময় দাও ওর স্কলারশিপ টা ঠিক হয়ে গেলেই ,বিয়ে হবে ওরাই আসবে প্রস্তাব নিয়ে, মা চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন তারপর বললেন তুমি ভাল করে মাহিনের সাথে কথা বল মা । সেদিন রাতেই বড় দাদা আর বড় আপু এলেন বাসায় ,মিলিকে ডেকে নিয়ে অনেক বোঝালেন পাত্র কতো ভাল ,তার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস , বাড়ি গাড়ি আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলে ইউনিভার্সিটির টিচার ,কিন্তু মিলি তার সিদ্ধান্ত পরিষ্কার জানিয়ে দিল বলল দুদিন পর মাহিন ও কোনোদিক থেকে কম কিছু হবে না হোক সে গ্রামের ছেলে ।
বড় দাদা বললেন বেশ তবে মাহিন কে বল তার অভিবাবকদের নিয়ে এসে কথা পাকা করে যাক ,আমরা রাজী তোমার ইচ্ছেতেই হোক তোমার বিয়ে । মিলি সারারাত ঘুমায়নি আনন্দে ।
সকালে মিলি মাহিন ফোন করে বলে আজ খুব জরুরী কথা আছে আমি স্কুলে যাবো না তুমি টি এস সি এসো এখনি ,
মাহিন বলে আসছি ১০ টায় । ওরা বসে মাঠে গাছের ছায়ায় মিলির সব কথা শুনে মাহিন বলে'' বুঝলাম সবই কিন্তু জানিনা এখন বাবা রাজী হবেন কি না রুমার বিয়ে দিতে হবে আমার যাবার টাকা যোগার করতে হবে , তার চেয়ে তুমি ভুলে যাও আমাকে ,বাড়ির পছন্দেই বিয়ে করো '' মিলি নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনা ,বলে তোমাকে কেউ এখন বিয়ে করতে বলছেনা শুধু এসে পাকা কথা বলে যাওয়া । বুঝেছি মিলি কিন্তু বাবা এখন এটা রাজী হবেন না আমি জানি। তুমি রাজী করাতে পারবেনা ? আমি নির্লজ্জের মতো আমার বাড়িতে বলতে পারলাম আর তুমি পারবেনা ? মাহিন বলে মনে হয়না মিলি দেখি আগে বর আপার সাথে কথা বলি ,মিলি কিছু না বলে চলে আসে, নিজের রুমে ঢুকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এই কি ভালোবাসা ?
বিকেলে মাহিন ফোন করে বলে মিলি কাল দুপুরের পর একটু সময় কোর আপা কথা বলবেন তোমার সাথে ,আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে অভিমান নিয়ে অস্ফুতে বলে আচ্ছা ।
স্কুল থেকে সেদিন আগেই ফিরেছিল মিলি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজে সে , আপার ছোট্ট রনির জন্যে একবাক্স চকোলেট কিনে এনেছে আর মাহিনের জন্যে ৫টা গোলাপ , ঠিক ৫ টায় মাহিন এসে বেল দেয় মিলি দৌড়ে নামে মা বলে কোথায় যাচ্ছ তুমি ? মিলি বলে মাহিনের সাথে কিছু কথা আছে মা ...যা বলার বাসায় বসে বল ।মিলি খুব অবাক হয় মা এভাবে কখনত বলেন না ...আসলে মায়ের মন দুই দিন ধরে মিলিকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কাল দুপুরে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে কারন জানতে চাইলে বলল মাহিন একটু সময় চাইছে বাবাকে বোঝতে হবে ।আজ আবার এভাবে বাইরে যাচ্ছে দেখেই মনটা কেমন করে উঠলো না জানি আজ আবার কাঁদতে হয় মেয়েকে !
ড্রয়িং রুমে বসে আছে মিলি মাথা নিচু করে মাহিনের আপা বলেই যাচ্ছেন তোমার বাড়ির লোক হঠাৎ এত ক্ষেপে উঠলো কেন বিয়ের জন্যে ? মাহিন বিদেশ যাচ্ছে ডিগ্রী নিতে তাই ? মিলি অবাক হয় এসব উনি কি বলছেন উনি ত অনেক আগে থেকেই সব জানেন মিলি এ বাড়িতে আগেও এসেছে ...সে ধীরে ধীরে বলে না আমাদের কথা ভেবেই আমার অভিভাবকরা চাইছেন পাকা কথা হয়ে থাক , উনি বলেন তা অসম্ভব ,অজান্তেই মিলি প্রশ্ন করে কেন ? কারন ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ওর বিদেশ যেতে ৩ লাখ টাকা লাগবে সেটা মেয়ে পক্ষ দেবে । তোমাকে বিয়ে করলে কি পাবে সে ?শিক্ষা আর রুপ ধুয়ে কি পানি খাবে ? এসময় মাহিন বেড়িয়ে আসে বলে আপা থামো কি বলছো এসব ? আমি যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবো ? সে টাকায় বিদেশ যাবো কি করে তোমরা এমন ভাবলে ? আপা বলেন তুই থাম কাল বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে শহরের মেয়ে বিয়ে করাবে না বাবা পরিষ্কার তোকে জানাতে বলেছে তাই ওর সামনেই জানিয়ে দিলাম আমি ।বাকিটা তোর ব্যাপার বাবার সাথে গিয়ে কথা বল । মিলি বেড়িয়ে পড়ে দরজা খুলে সিঁড়িতেই রনির সাথে দেখা চকোলেটের বাক্সটা ওর হাতে দিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে আর অপমানে ভাংতে থাকে তার সত্ত্বা বাতাসে ভেসে আসে ভাই- বোনের তুমুল ঝগড়া । মিলি বাড়ি ফেরেনা মেরিনার বাসায় যায় ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে । নির্বাক মেরিনাও কি বলবে বুঝতে পারেনা । সন্ধায় মিলিকে নিয়ে সে বাসায় আসে কিছুক্ষন পড়েই আসে মাহিন মেরিনা এসে দাঁড়ায় বলে ''কি বলবে আমাকে বল , মিলি ঘুমুচ্ছে এসময় মিলির আপুও এসে পড়ে উনি বলেন হ্যাঁ আমাদের বল কি বলবে ? কবে আসবে তোমার বাবা পাকা কথা বলতে ?
মাহিন কিছুক্ষন চুপ করে থাকে ,তারপর বলে আপু ভালই হল আমি মিলিকে কিছু বলতে পারতাম না তাই বাসায় এসেছি আপনাদের বলে যাই বাবা এই বিয়েতে রাজী নয় ? আপু আর মেরিনা তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চায় তুমি ? আমি বাবার অবাধ্য হতে পারব না । আপু বলেন বেশ তুমি যেতে পারো এখন । মেরিনা বলে দাঁড়াও কেন তাহলে এতদিন মিলিকে নিয়ে খেললে তুমি ?
আমি খেলিনি মেরিনা সত্যি আমি ওকে ভালোবাসি কিন্তু আমি আমার উপায় নেই । আপু বলেন বেশ তুমি আসতে পারো । মিলিও তখন দরোজায় দাঁড়িয়ে সব কথাই সে শুনেছে ''সে বলে এ তোমার শেষ কথা মাহিন ? '' ‘মিলি বিয়ে করে ফেল আমার জন্য বসে থেকো না ।’ এর পর আর কিছুই বলার থাকেনা। এত দিনের ভালবাসা একটা কথায় শেষ! মাহিন মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে চলে যায় ।
পৃথিবীটা দুলছিল মিলির ; নিজেকে কোন রকমে ওদের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেদিন। নিজের ঘরে এসে খুব কেঁদেছিল। এই অপমান সইতে হবে কখনো ভাবতে পেরেছিল কি সে ?
মিলি কি করবে? মাহিনের নির্লিপ্ততা উদাসীনতা অপমান তাকে দারুন আহত করেছিল। মাহিন জার্মানি যাবে তারই তোড়জোর চলছিল তার বাড়িতে। মিলি অভ্যস্ত হয়ে ওঠে একাকী জীবনে ।মা আর সে এই তাদের সংসার, সংসারে ভাই ভাবিও ছিলেন , মিলি চাকুরী বদল করে ব্যাংকে জয়েন করে । ভাই বোন মিলির সাথে কতদিন কথা বলেনি কারন মিলি কেন বিয়ে করবে না , মৌ এই বাসায় আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো । ভাবীরা কত কথা বলতো মিলি চুপ করে না শোনার ভান করতো ,মা একাকি অনেক রাত অবধি জায়নামাজে বসে কাঁদতেন ।
এসময় মায়ের দুঃসম্পর্কের এক বোন এলো বেড়াতে সাথে তার মেয়ে - জামাই। জামাই কিছুদিন পরেই বিদেশ যাবে পরে বাচ্চা আর তার মা কে নিয়ে যাবে । মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে হবে প্রতিদিন মা কিংবা ভাবী ওদের নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে মিলি শুনতে পায় রুবার অবস্থা ভাল নয় জটিলতা অনেক মা আর বাচ্চা দুজনেই ঝুকিতে আছে ।
মিলি এসব ভাবতে ভাবতে অফিসে পৌছায় কিন্তু কাজে মন বসেনা কেবলই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভাবে এতকাল পর মাহিন না এলেই তো ভালো ছিল এক মুহুর্তেই কেমন এলোমেলো করে দিল ওকে আচ্ছা সে নাম্বার পেল কোথায় ? ভাবতেই হাসি পেল তার বন্ধুরা ত নাম্বার জানেই কারো থেকে নিয়েছে নিশচয়। মিলি বাড়িতে ফোন করে শরিফাকে মনে করিয়ে দেয় কথাকে স্কুল থেকে যেন ঠিক সময়ে নিয়ে যায় । আজ আর কাজে মন বসবে না সেও ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাবার জন্যে তৈরি হয় । আবার ফোন বেজে ওঠে ----হ্যালো বলেই আর কিছু বলতে পারেনা সে
- মিলি আছ কি?- আছি।-
বলো তোমার কথা বলো। তোমার হাসবেন্ড, তোমার সন্তান এদের কথা বলো।-
কিছু নেই।- হাসবেন্ড কি করেন?- নেই তো?- মানে কি? হেঁয়ালি রাখো মিলি।-
তোমার মেয়ে এবার কোন ক্লাসে ?
---ফোরে পড়ে ।
----বেশ ওর বাবা কি করেন ?
----- জানিনা তিনি নেই ওর জন্মের পর পরইচলে গেছেন তার আগে চাকুরী করতেন
----দুঃখিত মিলি তোমাকে কষ্ট দিলাম ।
---- না ত কষ্ট কেন পাবো আপনার কথা বলুন
---সে অনেক বড় গল্প, আজ থাক।
---- বেশ থাক তবে আমি রাখি মিলি লাইন কেটে দেয়
বাড়ি ফিরে গান শোনে আর কেবলি পুরনো কথা মনে হয় খুব বেশি মায়ের কথা মনে পড়ে আজ । কথা এসে জড়িয়ে ধরে মা-মনি
তোমার আজ কি হয়েছে ? কিছু না রে ভাল আছি ত বেশ ।
কথার দিকে তাকালেই বুকটা হু হু করে ওঠে এই পৃথিবীতে কথার কেউ নেই মিলি ছাড়া । ও খুব একা ।
এসময় শরিফা এসে বলে খালাম্মা ''একটা লোক আইছে আপনের লগে কথা কইতে চায় ''
মিলি ড্রয়িং রুমে এসেই চমকে ওঠে , এ কোন মাহিন ? কাকে দেখছে সে? অনেক বয়স হয়ে গেছে, মনে হয় অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আসা একটা মানুষ। খুব পরিচিত খুব আপন তার। আপনি বসায় এলেন কি মনে করে ?
--তোমাকে খুব দেখতে মন চাইলো আর কথা কেউ দেখতে এলাম । খালাম্মা কই মিলি ? আর ছোট ভাইয়া ভাবী ছোট টুনি কেমন আছে ? মৌ এখন কোথায় ?
--হেসে ফেলে মিলি বলে আপনি কিছুই ভোলেন নি দেখছি ওরা কেউ নেই মা মারা গেছেন গতবছর ।মৌ কানাডায় থাকে আর ভাইয়া -ভাবী ইংল্যান্ডে এই বাড়িতে এখন আমি আর কথা আছি। আছে আমার ওই বিছানাটা যা খুব প্রিয়। আছে দখিনের জানালা, দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। ক্যালেন্ডারের নিচে লুকিয়ে থাকা টিকটিকিটা। খাঁচায় লাভবার্ড আর মুনিয়া। আর খুব সুন্দর একটা বেড়াল; এই তো বেশ! মানুষের সঙ্গ আমার ভাল লাগেনা। এরা সব আমার সঙ্গী।
আপনি কেমন আছেন? ভাবিকে নিয়ে আসেন একদিন।
---- হা হা মিলি আমি একা। তোমার ভাবি সেই এক্সিডেন্ট এর পর ছেড়ে চলে গেছে।-
এক্সিডেন্ট? সে কি? কিসের এক্সিডেন্ট!
- এখন ভালো আছি। একটা পা বাদ দিতে হয়েছে। একটা কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে।সে অনেক কথা, থাক মিলি। আমি সেই আগের আমি নেই। সময়ের নিষ্ঠুর থাবায় আমি ক্ষত-বিক্ষত । এলাম মা’কে দেখতে। ১৫ দিন পর ফিরে যাব। কাল পুরনো ডায়রি উল্টাতেই কিছু শুকনো গোলাপ পাপড়ি ঝরে পড়ায় খুলে দেখি তোমার চিঠি, তারপর থেকে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তারেকের কাছ থেকে তোমার নাম্বার নিলাম । তোমার যাপিত জীবনের কিছু কথা বলো মিলি।-
-- হা হা যাপিত জীবন! ভালই বলেছেন। ভালো আছি। নিজের সাথে আর কথার সাথে প্রতিনিয়ত লুকচুরি খেলি । মেঘের সাথে মিতালী আমার। কথার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি ওর জন্য অনেক কিছু করতে হবে আমাকে জীবনের সাথে লড়ে যাচ্ছি একা স্মৃতিতে সাতার কাটি , চাঁদনি রাতে একাকী গান শুনি কথাকে নিয়ে জ্যোৎস্না দেখি । শুনি টিকটিকির টিকটিক, যেন জানান দিচ্ছে আমি আছি! আমি আছি!-
----এখনো দেখি আগের মতন আছ একটু পাগলাটে সরল।
- ভাগ্যিস! বাচাল বলেননি। মাহিন ! যে স্মৃতি দিয়েছি ভাসিয়ে ইছামতির জলে আজ কেন ডাকা তাদের বলেন?
এইতো বেশ আছি খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, অফিস করছি। আর হচ্ছে নিজের আত্মার সাথে কথোপকথন,"মনে রেখো মনে রেখো সখা যেনো কেউ আর মনে রাখিবে না। আজ সব দৃশ্য মুছে গেছে সম্মুখ থেকে।" এইতো বেশ তাই না?
---বাহ বেশ গুছিয়ে কথা বলো তো?- সময় শিখিয়েছে যেমন আপনি শিখিয়েছিলেন।
মনে পড়ে সেই জিয়া উদ্যানে বট গাছটার নিচে দু’জন বসে গোধূলির আলোয় বাদাম খাচ্ছিলাম আর কথার ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন। সেদিন আপনাকে খুব আপন লাগছিল!! মাহিন আমি সব ভুলে গেছি, কিন্তু এই কথাগুলো ঠিক মনে আছে। আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি টেপ করে রাখলে পৃথিবীর যেকোন গীতিকবিতার শ্রেষ্ঠ সঙ্কলন হতে পারতো; হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই। আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর শিশির হয়ে ঝরে পড়ে, মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে।
মাহিন, আমি ঠিক তেমন আছি। বিশ্বাস করুন এখন আর ভালো লাগেনা প্রেম ভালবাসার কথা শুনতে। আজ কেমন অচেনা লাগে সব। আমিতো ছিলেম বেশ। কেন আপনি সব তছনছ করে দিলেন বলবেন কি? আমিতো সেদিন আমার সবটুকু নিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম আপনার সামনে। কেন পারেননি নিতে আপন করে জীবনের সাথে বলেন তো মাহিন ? না না আর কোনো দিন আমি আর আপনি- আসবেন না ।
---না না মিলি থাক পুরনো কথা। মিলি বিশ্বাস করো, তুমি কেমন আছ জানতে চেয়েছিলাম আর কিছু নয় তবু একটি বার বাইরে আসবে কি? সেই সেদিনের মতন আকাশনীল বুটিদার শাড়িটি পরে এলোচুলে কপালে কালো টিপ। আসবে মিলি? শুধু একটিবার দেখব সেভাবে দেখবো ! তোমায়। মিলি কথা বলছ না কেন? কেঁদোনা মিলি, প্লিজ কেঁদোনা।
মিলির বুকের ভেতর জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে এক্ষুণি লাফিয়ে পড়বে ঝরনা হয়ে।
সবই আমাদের নিয়তি মিলি!- মাহিন , আমি সত্যি অপরাগ। ক্ষমা করবেন। আমায় যেতে হলে সত্যভঙ্গ হবে। নিজের সাথে প্রতারণা করা হবে। প্লিজ কিছু মনে করবেননা ।
অনেক্ষন পর মাহিন বলে কথা কই ওকে দেখবো ডাকো একবার ।
কথা এলে মিলি বলে তোমার আঙ্কেল হন উনি । কথাকে দেখে চমকে ওঠে মাহিন ও চলে গেলে বলে কথা তোমার মেয়ে মিলি ?
---- চমকে ওঠে মিলিও এ কথা কেন ? কথার চেহারার সাথে শাহিনের চেহারার অনেক মিল । কিন্তু শাহিন ত অনেক আগেই বিয়ে করেছিল ওর বউ এর নাম ছিল রুবা আমি একবার দেশে এসেছিলাম তখন রুবা খুব অসুস্থ ছিল এরপর ওদের কিছু জানিনা ,এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মাহিন ।
বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে মিলি বলে হ্যাঁ কথা রুবার মেয়ে আমার বোন রুবা কথার জন্ম মুহুর্তে মারা যায় ,আর কথার বাবা বিদেশে চলে গেছে ওকে ফেলে আমি আর মা কথা কে মানুষ করেছি এখন মা নেই আমি আর কথা খুব একা । মাহিন বলে ওর শাহিন খোঁজ নেয়না মেয়ের ?
--- অনেক খবর দেয়া হয়েছিল উত্তর আসেনি শুনেছি আর একটা বিয়ে করেছে নতুন করে জীবন শুরু করেছে । কথা জানে ওর বাবা কে ?
-- না সে তার বাবা মার কথা কিছু জানে না অনেকেই ওকে এসব বলে কিন্তু সে বিশ্বাস করেনা সে জানে আমি তার মা আর তার বাবা বিদেশে কোনদিন আসবে না ...
---- দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে মাহিনের বুক চিরে বলে এস আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি
--- না তা হয় না আপনি আসুন বলে চলে যায় সে ,মাহিন ধিরে ধিরে বের হয়ে আসে ।
সেদিন মিলি আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে মনে মনে বলেছিল,মাহিন আমি খুব ভালোবাসি আজও তোমায়।’
আজ দু’দিন লাভবার্ড দু’টো কেবল ডানা ঝাপটাচ্ছে, এদিক ওদিক করছে, খাঁচার মুখ খুললেই ছুটে পালাবে এমন। মিলি চেয়ে দেখে ওই লাভবার্ড জোড়া এক সাথে গা ঘেঁষে বসে আছে। একটু পর পর দানা খুঁটে মুখে দিচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে উঠে পাখি দু’টোকেই ছেড়ে দেয়। খাঁচার মুখ খুলে দেয় মিলি। কি অবাক কাণ্ড! ওরা যায়না, খাঁচা থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে ঘরের, খাঁচায় বন্দী পাখি কি উড়তে ভুলে গেছে? সেও যেমন ভুলে গেছে ভালবাসতে! খুলে রাখে ডালা, পাখি দু’টো ঘরময় ঘুরে বেড়ায়।
হেলান চেয়ারে বসে মিলি দেখে পাখিদের, আর নীল আকাশে মেঘের লুকোচুরি খেলা। জানালার ফাঁক গলে আসা এক চিলতে রোদ পড়ে ঘরে। আঁকিবুঁকি করে মেঝেতে কি অপূর্ব আলপনা গাছের পাতার! ঠিক তখনি আবার বেজে উঠলো ফোন। ধরতেই ভাস্কর,
- মিলি আমি চলে যাচ্ছি। একটিবার এসো প্লিজ এয়ারপোর্টে, দূর থেকে দেখব তোমায়। মিলি, যে ভুল করেছিলাম তার শাস্তিতো পাচ্ছি, আর কেন? বাকিটা জীবন একটু শান্তি চাই মিলি আসবে তো?- আসবো, খুব আস্তে বলে মিলি।
- এত আস্তে বলছ মিলি! এসো কেমন? আমি কিন্তু সত্যি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।
তিনটে বাজতে দেরী নেই। কেন যে এখনো ক্যাব নিয়ে আসছেনা গার্ড! ছটফট করছে মিলি। সেজেছে সে নীল শাড়িতে। ক্যাব আসতেই আর একবার টিপ ঠিক করে নিয়ে রওনা দিল।
রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে এলো এয়ারপোর্টে। তখন ঘোষণা দিচ্ছে মাহিনের ফ্লাইটের; ইস্ আরেকটু দেরী হলেই আর দেখা হতো না! এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মিলি, মাহিন কই? হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। ঠিক এমন সময় একটা উষ্ণ হাত মিলির কাঁধ ছুঁলো। চমকে দেখে, মাহিন ! হাতে টিকিট আর বোর্ডিং পাস, হাসছে ও! মিলি কেঁপে উঠলো। চোখ ছলছল।
- এই মিলি কি হলো?
নিজেকে পারল না ধরে রাখতে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিলি। মাহিন বলে মিলি তুমি এখনো ভালোবাসো আমাকে তাই তুমি আমার কথা রেখেছ । প্লিজ তুমি একবার হ্যাঁ বল আমরা আবার জীবন শুরু করি চলো !
না মাহিন তাহলে আমি হেরে যাব নিজের কাছেই ...সেই অপমানগুলো আমি ভুলিনি ।
--- তার শাস্তি ত তুমি কম দিলে না আমাকে , বিয়ে করনি নীরবে আজো ভালোবেসে যাচ্ছ !
---থাক না মাহিন আমি যাই তুমি ভালো থেক নিজের যত্ন নিও ।
মিলি হাঁটতে শুরু করে বুকে হু হু করে কান্না দাঁড়াও মিলি পিছু ডাকে মাহিন
---বল ,
--- আমাদের মেয়ের কথা ভেবেও কি সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারনা মিলি ? এখন জেদ না করলেই কি নয় ? তুমি একা একা আর কত পথ চলবে ? কথার বিয়ে দিতে গেলে কত প্রশ্ন উঠবে তুমি জানো মিলি ?
---- মিলি থমকে দাঁড়ায় আমাদের মেয়ে মানে ?আর এতোটা পথ যখন আসতে পেরেছি বাকী পথও যেতে পারবো ভেবো না তুমি ।
মানে কথা যেমন তোমার বোনের মেয়ে তেমন আমার ভাইয়েরও মেয়ে তাহলে ?
থমকে যায় মিলি ...।
মিলি আমি আজ যাবনা কথা আর তোমাকে এভাবে একা ফেলে আমি যাবো না তোমার অমতেও কিছু করবো না ।শুধু অনুরোধ করবো ভেবে দেখো ।
মিলি কিছু না বলে হাঁটতে থাকে একা দুরন্ত অভিমানে ফুলে ফুলে আসে কান্নার ঢেউ ।
ঢাকা ।
গল্প,উপন্যাস সচরাচর পড়া হয়ে ওঠে না।কিন্তু ফারহানা'র "সময়" গল্পটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।অভিনন্দন।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন