ইন্দ্রাণী সরকার


স্বপ্ন নগরী ভেনিস

ভেনিসকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অবাস্তব শহর, সেই সাথে সবচেয়ে রোমান্টিকও! সে এক অন্য ভুবন, অনন্য তার রূপ, সেই সাথে এমন এক অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ভেনিস যে তার তুলনা কেবলমাত্র সে নিজেই। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে ভেনিসের মোট আয়তন মাত্র ৮ বর্গ কিমি, কিন্তু প্রায় ৪০০ সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত প্রায় ১১৭ টি ক্ষুদে দ্বীপের এই শহরে একবার প্রবেশ করলেই একে মনে হয় সীমাহীন, চারিদিকে কেবল জলেরই রাজত্ব।

ভেনিসে বছরের সবগুলো দিনই পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম, মানুষের ভিড়ে হাটাই মুস্কিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই লাখো লাখো লোকের মধ্যে শতকরা ৭৫ জনই বিমুগ্ধ দর্শনার্থী, যারা দিকভ্রান্ত হয়ে চলাচল করতে করতে দুচোখ ভরে পান করছে সেই রূপসুধা। এ এক অনন্য শহর যেখানে গাড়ী, ঘোড়া, বাস যাবতীয় স্থলযান অচল, শহরের যেখানে শেষ সেখানকার প্রান্তসীমায় রেলষ্টেশনে নামার পর থেকেই যাত্রা শুরু হয় পদব্রজে নতুবা নানা ধরনের জলযানে, এই সবার ভরসা।

আক্ষরিক অর্থে ভেনিস ত' নির্মিতই হয়েছে এই জলভূমির উপরে | এর মাঝে আবার আছে শহরটিকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা সবচেয়ে চওড়া খাল যা পরিচিত গ্র্যান্ড ক্যানেল নামে জগদ্বিখ্যাত, স্থাপনার জগতে এক অটুট বিস্ময় এই গ্র্যান্ড ক্যানেল।
গ্র্যান্ড ক্যানেল থেকে অসংখ্য ছোট ছোট খাল। সেগুলো ঢুকে গেছে স্থলভূমিতে। তৈরি করেছে ১১৭টি দ্বীপ। এই দ্বীপে বাস করা মানুষগুলোর পূর্বপুরুষেরা একদা এসেছিল বাইরে থেকে। পঞ্চম শতাব্দীতে এড্রিয়াটিক শহরের উত্তরের অঞ্চল থেকে কিছু লোক বর্বর জাতিদের অনবরত আক্রমণে টিকতে না পেরে উত্তরকূলের এক জলাভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করে। স্থলের চেয়ে জলই বেশি। কিন্তু জীবন বড় অমূল্য। তারই তাগিদে একদা যে বাস্তুহারা মানুষগুলো কঠিন জীবনযাপনে তৈরি করেছিল যে দেশটি, তা আর শুধু জলাভূমিতে সীমাবদ্ধ রইল না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সেদিনের ভেনেজিয়া হলো আজকের ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের ভেনিস। খালের অগাধ জলরাশি, নৌকা নামের গন্ডোলা, মাঝির উদাত্ত উদাসী সঙ্গীত, পিয়াৎসা সেন্টমার্টিন, শত পায়রার ঝাঁক। গলি-গলিতে সাজানো দুর্লভ সামগ্রীর দোকান, রিয়ালটো ব্রিজ, টুরিস্টদের স্বর্গ। গ্র্যান্ড ক্যানালের দু পাশে বড়বড় প্রাসাদ, চার্চ, রেষ্টুরেন্ট বাসাবাড়ি আর দোকানপাট। ১৭৭টা খাল এই দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ।


গ্র্যান্ড ক্যানালে ওয়াটারবাস,স্পীডবোট আর পুলিশের বোট আর ওয়াটার এম্বুলেন্স সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে । আর প্রতিটি স্টপে কিছুক্ষন পর পর যাত্রী নেয়া ও পৌঁছানোর জন্য ওয়াটারবাস থামছে ।
সেই সাথে খানিক পরপরই খাল পারাপারের জন্য বাহারী সব সেতু। নয়ন জুড়ানো রঙ, নকশা, স্থাপত্যশৈলীর। এর মাঝে গ্র্যান্ড ক্যানেলের উপরের বিশাল সেতুটাই সবচেয়ে জমকালো।
ভেনিসে বসবাসরত সব পরিবারেরই নিজস্ব জলযান আছে, যা বাড়ীর সদর বা খিড়কি দরজার কাছে বাঁধা, নামী হোটেলগুলোরও প্রত্যেকেরই আছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

গন্তব্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতেই দেখি সেখানকার ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের সামনে হাজির হয়ে গেছি, টিকিটের বালাই নেয়, সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সোজা চোখ পড়ে কোটি বছর আগে সাগর দাপিয়ে বেড়ানো ইকথিওসরের জীবাশ্মের উপরে। বিশ্বের নানা কালে সংঘটিত প্রাকৃতিক পরিবর্তন আর জীবজগতের বিবর্তনের নমুনা থরে থরে সাজানো। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হল ১১ কোটি বছরের পুরনো ৩৩ ফিট লম্বা সুপ্রাচীন কুমির সুপার ক্রোকের জীবাশ্ম, যার খাদ্য তালিকার অন্যতম ছিল নানা প্রজাতির ডাইনোসর!


এখানেই কোন বাড়ীতে জন্মে ছিলেন পর্যটক গুরু মার্কো পোলো, ১৭ বছর বয়সে ভেনিস ছেড়ে সুদূরের পিয়াসে বাবা-কাকার সাথে রওনা দিয়েছিলেন কুবলাই খানের চীনদেশের উদ্দেশ্যে, প্রথম দিককার একজন ইউরোপিয়ান হিসেবে চীনে যাবার পর দীর্ঘ ২৬ বছর পর আবার ফিরে আসেন ভেনিসে, বিশ্বকে শোনান তার অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী। ভেনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত অধিবাসী হিসেবে তাকে বলা হয়ে থাকে, দর্শনার্থীরা খুজে বাহির করতে চান কোন বাড়ীতে থাকতেন এই ভ্রমণপিপাসু।
এখানেই হয়ত হেঁটে বেড়াতেন চিন্তামগ্ন বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, যিনি ভেনিসে স্বল্প সময়ের অবস্থান কালে বিশ্বের প্রথম ডুবুরীর পোশাকের নকশা করেছিলেন।
ভেনিসের বাড়ীগুলো আজো তেমনটাই আছে যেমন ছিল পাঁচশ বা হাজার বছর আগে, অনেক জায়গাতেই চুন পলেস্তারা খসে পড়েছে, ছাদটাও মনে হচ্ছে ভেঙ্গে পড়ার যোগাড় কিন্তু মহাকালের করাল গ্রাসকে অগ্রাহ্য করে টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আর আছে মুখোশ, ভেনিসের রঙবেরঙের মুখোশগুলো এমনিই জগদ্বিখ্যাত, তার উপর প্রতিবছর ফেস্টিভ্যালের সময় দর্শনীয় চিত্র-বিচিত্র সব মুখোশ শোভা পায় প্রায় সবার মুখে। সারা বছরই চলে তার বিকিকিনি গোটা শহর জুড়ে বসা দোকানগুলোতে। কি বাহারি এক একটা মুখোশ, কোনটা কেবল চোখ ঢাকার জন্য, কোনটা বা পাখির সুতীক্ষ ঠোঁটের মত, কোনটা বিশালাকৃতির, কোনটা আবার পালকময়। ওস্তাদ লোকের হাতের কাজ, দেখেই শ্রদ্ধা হয় তার সুক্ষ রুচি আর সমন্বয়ের মুন্সিয়ানার প্রতি |
ভেনিসে দারুণ ভাবে আকর্ষণীয় ক্যাথেড্রাল, জাদুঘর আর ভবনের সংখ্যা এত বেশী যে মাত্র কয়েকদিনে এর অর্ধেক দেখাও অসম্ভব |


ঘুরতে ঘুরতে এখন যে ভিড়ের ঠ্যালায় ভেনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য সেন্ট মার্কোর ক্যাথেড্রালের সামনে চলে এসেছি নিজেও বলতে পারব না।
এর সিংহদরজার উপরে শোভা পাচ্ছে চারটি প্রমাণ আকৃতির অতুলনীয় শৈল্পিক সৌন্দর্যের অধিকারী ধাতব ঘোড়ার ভাস্কর্য, এগুলো প্রায় হাজার বছর আগে বাইজেন্টাইন স্রামাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুল থেকে লুট করে আনা হয়েছিল, সেই থেকে ভেনিসই এদের ঠিকানা। বাহিরের দেয়ালে বাইবেলের নানা কাহিনী সুক্ষ চিত্রকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কাছের ল্যাগুনে গনডোলা আর জেলে নৌকার ভিড়, দৃষ্টিসীমার মাঝে কিছু ক্ষুদে দ্বীপ নজরে আসল, সেখানে বিস্ময় জাগানিয়া নানা স্থাপত্যে সমাহার ও কাঁচের কারখানা, উৎসাহীরা দল সেখানে যাচ্ছে দল বেঁধে।
কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার নগর পরিভ্রমণে, ভেনিসে যেহেতু কোন স্থলের যানবাহনের অস্তিত্ব নেই, তাই-ই হয়ত থেকে থেকেই বসার কাঠের বেঞ্চি সেই সাথে পকেট হালকা করার জন্য পানীয়ের দোকানের নানা লোভনীয় সমাহার।
গ্র্যান্ড চ্যানেলের উপরের বড় সেতুটাতে দাড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে, কৈশোরের স্বপ্ন নগরী ভেনিসে দাড়িয়ে আছি, সেতুর নিচ দিয়ে সাবলীল ভাবে মাঝিরা চলে যাচ্ছে নানা ধরনের জলযান নিয়ে, কি আশ্চর্য! চারপাশে সারা বিশ্বের সব দেশের মানুষ হাজির হয়েছে মনে হল, মহা হট্টগোলে চলছে ছবি তোলা।


ভেনিসে দারুণ ভাবে আকর্ষণীয় ক্যাথেড্রাল, জাদুঘর আর ভবনের সংখ্যা এত বেশী যে মাত্র কয়েকদিনে এর অর্ধেক দেখাও অসম্ভব। তাও প্রয়াস চালালাম, যদিও জানি বেশী সুখাদ্য একসাথে খেলে বদহজম হবার যেমন সমূহ সম্ভাবনা, তেমন বেশী সংখ্যক দর্শনীয় বস্তু অল্প সময়ের মাঝে দেখলে মনের পর্দায় সবগুলো উপরই চাপ পড়ে।
তড়িৎগতিতে শেষ হয়ে আসছে তিলোত্তমা নগরীতে অবস্থানের দিনগুলি, ক্যামেরায় এই অদ্বিতীয় স্বপ্নলোকের দৃশ্যপট ধারণ করতে করতেই চলে গেল সিংহভাগ সময়, শেষের দিন সারা সন্ধ্যা গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাড়ে বসে গোধূলিসূর্যের মৃদু আলো উপভোগ করতে করতে মনে হল, আহা, জীবন কতই না সুন্দর!

ইউ এস এ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.