
.jpg)
আন্দোলন করছে নবীন - প্রবীণ সবাই , সুবর্নাও প্রতিদিন বিভিন্ন কর্মসুচিতে যোগ দিচ্ছে । মানবতাবিরোধী এই যুদ্ধ ওদের বড় চ্যলাঞ্জে ,ওরা উত্তাল ওদের উচ্ছাস বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো তাই বলে ওরা অবুঝ নয়। আবার একটা চুমুক দিয়ে চা টা শেষ করে , মাগরিবের আজান হচ্ছে , সুবর্না উদাস চোখে সামনে তাকায় ,একটা একলা কাক লাইটপোস্টের উপর বসে এদিক ওদিক দেখছে, কিসের আশায় কে জানে! দূরে দুষ্ট ছেলের দল ক্রিকেট খেলায় ব্যাস্ত। বিকেলের ম্লান রোদ সন্ধ্যার আগমনীবার্তা নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছে। গোধূলি মায়াময় বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। রাস্তায় অফিস ফেরত মানুষের ঢল।
এমনি সময় ঘরের ভেতর ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে সম্বিত ফেরে সুবর্না । ছুটে এসে তুলে নেয় রিসিভার। ওপাশ থেকে ভাস্কর এর কন্ণ্ঠ হ্যালো শুনে কেঁপে ওঠে সুবর্না ।
- কি হয়েছে ভাস্কর ? প্রশ্ন করে সুবর্না । আমি ভাস্কর বলছি এবার চিনেছ?- হ্যাঁ কিন্তু কি হয়েছে এত উত্তেজিত কেন তুমি ?কেমন আছো ?
-----এইতো ভাল আছি ,শোন বর্না আমার মাকে বোল আমি ভাল আছি কয়দিন বাসায় ফিরবো না ।
----কিন্তু তুমি নিজে বলছনা কেন ? কেন বাসায় ফিরবে না ?
---কাজ আছে বর্না অনেক কাজ , খুব ব্যস্ত থাকবো চিন্তা করো না । তুমি ঠিক থাকবে আর কাজ করে যেও কিন্তু সাবধানে থেকো ।ঘাতকেরা ওঁত পেতে আছে সবখানে ।
----বেশ থাকবো তবে তুমি রোজ যোগাযোগ রেখো
-----চেষ্টা করবো , ভালো থেকো ।রাখি । তারপরেই লাইন কেটে যায় । সুবর্না নামাজ পড়তে যায়।
ভাস্কর আজ ভীষণ উত্তেজিত ছিল ,কিছু ছেলের সাথে সকালে তার তুমুল তর্ক হয়েছে ,এরা দেশকে হেউ করে কিছু কথা বলছিল এরা আন্দোলন ,বিচার এসব কথা শুনতেই পারেনা তবুও ওদের সাথেই থাকে , কথায় কথায় আজ তর্ক বেঁধে গেল । ভাস্করকে অনেক কিছু বলেছে এক পর্যায়ে জীবন নাশের হুমকিও দেয় ,এরপর থেকে ওর মোবাইল এ সমানে ভয় -ভীতি দেখিয়ে মেসেজ আসছে । ও ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার ছেলে নয় ।ওর ভয় ছিল সুবর্নাকে নিয়ে যদি ওর কোন ক্ষতি করে ওরা ? কারণ ওদের সম্পর্কটা কারো অজানা নয় । আর চিন্তা ছিল মা'' মা খুব দুশ্চিন্তা করবে একদিন বাড়ি না ফিরলে ,তাই বাড়ি না ফেরার খবরটা দেবার জন্য সুবর্নাকেই করলো আর সতর্ক ও করলো । আজ সারারাত ওদের পথনাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে মহড়া দিতে হবে ,সুন্দর কিছু শ্লোগান তৈরি আর সাংগঠনিক কিছু সিদ্ধান্ত ও নিতে হবে অনেক কাজ অত রাতে বাড়ি ফেরা উচিত হবে না আজ ।
এ ভাস্কর যাকে খুব ভালোবাসে সুবর্না । ওরা এক্নে্সাথেই পরাশুনা করে ।এইত সেদিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে মাঠে বসে কথা বলছিল কজন বন্ধু মিলে , বিভিন্ন বিষয় নিয়ে , বলছিল আজ এতকাল হয়ে গেল যুদ্ধঅপরাধীদের বিচার হোল না , বেকারত্ব বাড়ছে দুর্নিতি , মুদ্রাস্ফীতি , আরও কত সমস্যায় জুর্জরিত এই দেশটা , অনেকে অনেক রকম মত দিচ্ছিল কিন্তু একজায়গায় ওরা একমত সময় এসেছে দেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে ,উন্নতির কথা ভাবতে হবে কাজ করতে হবে ।
অনেকের মতে এই প্রজন্ম নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবে না ,এদের কানে হেডফোন ,হাতে দামী মোবাইল আর অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান্দের বগলে ল্যাপটপ থাকে আর সাথে থাকে বন্ধু বান্ধবী ।কিন্তু অনেকেই ধারনাও করতে পারবে না এদের অনেকেই দেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে অনেক ভাবে । এরা মুক্তিযুধের গল্প পড়ে নেটে ,যা আমরা অনেকেই বই কিনেও পড়িনি। এরা রাজনীতি বোঝে কি না কে জানে তবে এরা দেশকে নিয়ে ভাবে ।অনেকেই লেখালেখিও করে এসব নিয়ে।
তা না হলে এই যে সেদিন এক রাজাকারের বিচারের রায় হোল ওরা তা মানতে পারলো না শুধু ওরা নয় দেশের বেশিরভাগ মানুষই তা মানতে পারেনি ,ওরা নেটে যোগাযোগ করে বিশাল জনমত তৈরি করে ফেলল ।জড় হল একজায়গায় মুহুর্তেই হাজার হাজার মানুষ ওদের সাথে শামিল হোল । প্রতিবাদের ঝড় উঠলো ,যুদ্ধপরাধীদের সর্বচ্চ শাস্তি চাই । ওরা দাবী আদায়ের জন্য ঘর ছাড়ল ।
সুবর্না বই নিয়ে বসে , কিন্ত মন বসে না কিছুতেই কিছুক্ষন পর পর খবর দেখতে ছুটে আসে । মা বাবা দুজনেই অফিস থেকে এসেছে ,মা রান্না ঘরে ব্যাস্ত বাবা টি ভি দেখছেন ,সুবর্না কিছুক্ষন বাবার পাশে বসে ,দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে, হরতাল মারামারি মৃত্যু ধ্বংস সহ্য করা যায় না অথচ কিছু করার নেই । সবাই চিন্তিত কি হবে ? একটু পর মা ও এসে আলোচনায় যোগ দেয় ,সবাই একমত একটা সুন্দর সমাধান হোক ।
বর্নার মোবাইলটা বেজে ওঠে ,ভাস্করের মা ফোন দিয়েছেন । ও ভুলেই গিয়েছিল ওনাকে ফোন দেয়ার কথা , ফোনটা ধরে বর্না সালাম দেয় ওই প্রান্ত থেকে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠ ভেসে আসে ...
----বর্না তুমি বাসায় ?
---জী আন্টী আমি বাসায় ,
----কখন এলে ? ভাস্কর ত এখনো এল না এত রাত হোল ...
--- আণ্টি চিন্তা করবেন না ও আজ বাসায় ফিরবে না মইনুলের সাথে থাকবে বলেছে।আপনি ভাল আছেন তো ?
----হ্যাঁ মা আমি ভাল আছি রাখি তুমি ভাল থেকো কেমন
---জি আচ্ছা ।
সুবর্না ফোন রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় কি সুন্দর জ্যোৎস্না , ঝির ঝির হাওয়া ,আজ এসব কিছুই ওকে ছোঁয় না , মন ভাল নেই কয়েকবার ভাস্করের মোবাইলে ফোন দিল ও ধরছে না ,একবার কথা বলতে পারলে ভাল লাগতো । ফোন করে সুমন
---বর্না কাল আসছিস তো প্রতিবাদ সভায় ?
----হ্যাঁ অবশ্যই আসবো কিন্তু তুই কি ভাস্করের খবর জানিশ ?
----না রে ওরা অন্য কাজে গেছে আজ ফিরবেনা। চিন্তা করিশ না ওর সাথে রুবেল ,আর অনিক আছে ।
----জানি মইনুলের ওখানে গেছে ।
-----হা আমিও যাচ্ছি রে ...
---- বেশ , ভালো থাকিশ ।
-----রাখি ।
বর্না ঘুমাতে যায় সকাল থেকে আবার অনেক কাজ প্রতিবাদ ,ক্লাস অনেক কিছু ।
সকালে সুবর্না চা খেতে খেতে খবরের কাগজ টা নিয়ে বসে একটা খবর দেখে চমকে ওঠে ওর হৃদপিণ্ড যেন হঠাৎ থেমে যায় , দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে দুই যুবক আহত একজন ভাস্কর আর একজন সুমন দুজনেই হাসপাতালে । ওর কান্না শুনে বাবা মা দৌড়ে আসেন , খবর দেখে দুজনেই নির্বাক হয়ে যান । ভাস্করের মা কে খবরটা জানান বাবা ।
সবাই এখন হাসপাতালে ,পুলিশ ঘুরছে জবানবন্দী নিতে ডাক্তার বললেন রোগীদের অবস্থা ভালো নয় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে রক্ত দিতে হবে । বন্ধুরা ছুটে আসে ,যতটুকু জানাগেল কালরাতে মইনের রুমে ওরা একটা পথনাটকের রিহারসেল করছিল যুদ্ধপরাধ নিয়ে । বেশ রাতে ও আর সুমন বাইরে আসে চা খেতে এ ই সময় ৩/৪ জন যুবক ছুরি চালায় এলোপাথাড়ি ,ওদের চিৎকারে বাকিরা বেরিয়ে এলে ওরা পালিয়ে যায় ।
এরা ওদের সাথেই মিশে ছিল এতদিন কিন্তু ওরা যে কেমন বা অন্য মতের বোঝা যায়নি ,এতদিন ওদের স্বরূপ চিনেনি কেউ ।
জ্ঞ্যন ফিরে এলে সুবর্না ভাস্করকে দেখতে যায় ,ও বলে বর্না আমার কিছু হয়ে গেলেও তুমি হেরে যেও না । বর্না কাঁদতেই থাকে ওর কপালে হাত রেখে । পৃথিবীটা দুলছিল তার; নিজেকে কোন রকমে ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে । খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে সে।
তারপর কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে পার করলো সুবর্না সেই মায়াময় গোধূলি, ছোট্ট পাখির কিচির মিচির আর সেই স্বর্ণচাঁপা ভোর কোথায় হারিয়ে গেল সব!? চোখের কোলে শুধু জলের ধারা । সে একমনে ভাবে, ভাস্কর সেরে উঠুক তাড়াতাড়ি দুজনে আবার একসাথে লড়াই করবে । সেদিন সে একটা প্রতিজ্ঞা করে জীবন থাকতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সে লড়বেই। মানবতার এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়া চলবে না ।
ঢাকা ।
সুচিন্তিত মতামত দিন