শ্রীশুভ্র









"একুশের বাংলা বাঙালির একুশ!" 






অমর একুশের ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের বাঙালিদের  আবেগ আজ অর্দ্ধ শতাব্দী পেড়িয়ে গেল!
একুশ মানে মুখের ভাষা! একুশ মানে বাঁচার আশা! একুশ সৃষ্টিমুখর সৃজনশীল স্বাধীন প্রত্যয়! একুশ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় বরাভয়! একুশ বাঙালির জাতীয় পরিচয়! একুশের বিশ্ব আজ মাতৃভাষাময়!
বিশ্বসভায় একুশ আমাদের উপহার! মানুষের ইতিহাসে একুশ আমাদের অহংকার! অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে! অহংকার মাতৃভাষার গর্বে!

আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে একুশ বিশ্বসভায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অবদান! এই অবদানের পূণ্য উত্তরাধিকার আমাদের ঐতিহ্য ও দায়িত্ব! সেই ঐতিহ্য ও দায়িত্ব নিয়ে আজ আমাদের যথেষ্ঠ সচেতন হতে হবে! আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখেই!


বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের একটা বড়ো প্রেক্ষাপট ছিল! কিন্তু মূল বিষয়টা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার আবেগের থেকেও বড়ো ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন জীবিকার প্রশ্নে! পাক সরকারের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর একটা বড়ো শর্তই ছিল উর্দু না জানলে সরকারী বেসরকারী চাকুরীতে নিয়োগ হওয়ার রাস্তা বন্ধ! ফলে লেখা পড়া শিখলেই হবে না আবার বাধ্যতামূলক ভাবে উর্দুর মতো বিদেশী একটি ভাষা শিখতে হবে নতুন করে! এই জবরদস্তিটা মেনে নিতে পারেনি বাঙালি শিক্ষিত শ্রেনী! ফলে তারা প্রথম থেকেই এর বিরোধীতায় সরব হয়ে ছিল জীবন জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নেই! স্বভাবতই এই জবরদস্তির কারণে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্বন্ধে জনমানসে সচেতন আবেগ দানা বাঁধতে থাকল দিনে দিনে!


পাক সরকারের বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাঙালি! সরকারী জবরদস্তির ফলে দিনে দিনে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালির আবেগ সংহত হতে থাকল! বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজে এর প্রভাব পড়ল সুদূর প্রসারী! তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাইয়ের দাবীও জোরদার হয়ে উঠল দিকে দিকে! পাক সরকার চাইল দমন নীতি প্রয়োগ করে বাঙালিকে ভীত সন্ত্রস্ত করে  উর্দুকে জোর জবরদস্তি রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই চাপিয়ে দিয়ে বাংলাভাষা ও বাঙালিকে জব্দ করা যাবে!
কিন্তু ফল হলো উল্টো! বুমেরাং হয়ে ৭১এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল!

এখানেই একুশের ভূমিকা কি সুদূর প্রসারী ফল দিতে পারে বাহান্নর পাক প্রশাসন তা আন্দাজও করতে পেরেছিল না!
এখানেই দেখা যাক পশ্চিম বঙ্গের চিত্রটা! ভারতের অঙ্গ রাজ্য হিসেবে হিন্দী কিন্তু এ রাজ্যেরও রাষ্ট্রভাষা! কিন্তু কোনো সময়েই কোনো কেন্দ্রীয় সরকার জবরদস্তি  পশ্চিমবঙ্গের ওপর হিন্দী চাপিয়ে দেয়নি জুলুম করে! বরং অতি সন্তর্পনে হিন্দীকে জনমানসে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তুলেছে! বিশেষত একদিকে হিন্দী সিনেমা ও টিভির দৌলতে ও অন্যদিকে হিন্দীবলয়ের অধিবাসীদের ব্যপক অনুপ্রবেশে গত ছয় দশক ব্যাপী সময় সীমায় হিন্দী আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালির মুখের ভাষা হয়ে গিয়েছে! এখানেই ইসলামাবাদের সাথে দিল্লীর পার্থক্য! এবং লক্ষ করার বিষয় পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজী ও হিন্দীর পাশে বাংলা আজ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে!

ফলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষা প্রধানত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তার শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে! কারণ মানুষের জীবন জীবিকায় এ ভাষার বিশেষ কোনো কার্যকারিতা না থাকার কারণে এপাড়ে বাঙালি হিন্দী ও ইংরেজীতে নিজেদের শানিয়ে নিচ্ছে! ব্যাবসা বাণিজ্য থেকে চাকুরি ক্ষেত্র সর্বত্রই হয় ইংরেজী নয় হিন্দী ভাষায় অভ্যস্ত না হলে বাঙালির পেটে আজ আর ভাত জুটছে না! এই কারণেই আজ মধ্যবিত্তরা সন্তানের শিক্ষার জন্য ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে! এই পরিস্থিতিতে এবঙ্গে জনজীবনে একুশ কোনো রকম ভাবেই আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেনি! রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি না পেলে একুশ অলক্ষেই পড়ে থাকত!


যে ভুল দিল্লী করেনি সেই ভুল করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হাজারও চেষ্টা করে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি ইসলামাবাদ! ধর্মীয় জাতীয়তাবাদও ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে! যার সূচনা এই একুশের লাল রক্তেই!

কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও কতটুকু পুরণ হয়েছে একুশের চেতনা! কতটুকু অর্জিত হয়েছে বাংলাভাষার নির্ভরতা? বিশ্বসভায় বাংলাভাষা কতটুকু আদৃত হয়েছে বিগত বিয়াল্লিশ বছরে! আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাভাষা আদৌ কি কোনো গুরুত্ব অর্জন করতে পেরেছে? জাতীয়স্তরে বাংলাভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও উচ্চশিক্ষা অর্জন আজও কি নিশ্চিত করা গিয়েছে? বাংলা কি আজও জীবনজীবিকার উপযুক্ত ভাষা হয়ে উঠতে পেরেছে?

স্বভাবতই এই প্রশ্নগুলি আমরা এড়িয়ে যেতেই স্বস্তি বোধ করি! কিংবা আবেগের জোয়ারে ভেসে প্রশ্নগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকি! অথচ বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো এবং শিক্ষা বিস্তারের প্রনালী সবিস্তারে অনুসন্ধান করলে আবেগের বেশির ভাগ জোয়ারই থিতিয়ে যাবে! ক্রমবর্ধমান ইংরেজী মাধ্যম স্কুল ও ইংল্যাণ্ড অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার তৈরী ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা কারবারে স্পষ্টতই বোঝা যায় একুশের চেতনা আজ কোন চড়ায় এসে ঠেকেছে!বিশ্বায়নের তল্পি বহনের নামে এও এক নতুনভাবে পর ভাষা নির্ভরতার পরাধীনতার বৃত্তে বাঁধা পড়ে গিয়েছে এই প্রজন্মের বাঙালি! ভাঁটা পড়েছে একুশে!

শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মক্ষেত্রে ইংরেজীর এই ক্রমবর্ধমান দৌরাত্মের পাশাপাশি ভারতীয় হিন্দী সিনেমার জনপ্রিয়তা ও ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলির ঘরে ঘরে অনুপ্রবেশের হাত ধরে আজ হিন্দীভাষা বাংলাদেশের অধিকাংশ অধিবাসীর কাছে শুধু জনপ্রিয়ই নয়, এই ভাষা ওপাড় বাংলারও প্রায় মুখের ভাষাই হয়ে উঠেছে! এরই হাত ধরে ওপাড় বাংলার সংস্কৃতিতেও এপাড়ের মতোই হিন্দী ও ইংরেজীর প্রবল প্রভাবে দ্রুত হারাচ্ছে বঙ্গসংস্কৃতির নিজস্বতা! অনুকরণ প্রিয় বাঙালি এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নয় বলেই অবাধে এই ভাবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি তিলে তিলে হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্ব পরিসর নিজের জমি! আমরা কিন্তু দেখেও দেখছি না! বুঝেও বুঝতে চাইছি না!


বাংলা কি শুধুই মুখের ভাষা সাহিত্য সঙ্গীত নাটকের ভাষা হয়ে থাকবে? কাজের ভাষা, প্রয়োজনের ভাষা, জীবন জীবিকার ভাষা, অর্থনৈতিক নির্ভরতার ভাষা, বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে আগ্রহের ভাষা- ভালোবাসার ভাষা হয়ে না উঠতে পারলে, একুশের চেতনা শুধু শহীদ বেদীতে রাত বারোটায় মালা দিয়ে আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সভা সমিতি সেমিনার করে সার্থক করা যাবে না!

কোটি কোটি বাঙালির মুখের ভাষা হলেই সেই ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে না! ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে সুদৃঢ় জাতীয়তাবোধের উপর! ভাষাকে সযত্নে লালন করতে হয় রক্ষা করতে হয় অন্য ভাষার আগ্রাসন ও অনভিপ্রেত প্রভাব থেকে! আমরা বাঙালিরা দুঃখ জনক হলেও, ঐতিহাসিক ভাবেই এই বিষয়ে চির উদাসীন!


বিশ্বায়নের এই পরিসরে বহির্বিশ্বের প্রভাবে ভেসে না গিয়ে বিশ্বায়নকেই সুযোগ করে বাংলাভাষাকে জাতীয় স্তরে স্বাধীন দেশের ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আমাদের! এবং সেই সূত্রেই আন্তর্জাতিক স্তরে একটি শক্তিশালী সুদৃঢ় আত্মনির্ভর সমৃদ্ধশালী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাংলাকে! বর্তমান পরিস্থিতিতে যা সুদূর পরাহত বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক! আবেগ সর্বস্বতায় কল্পনাবিলাসে আত্মগর্বে উদ্বেলিত না হয়ে, কঠিন বাস্তবকে অনুধাবন করে সমস্ত প্রতিকুলতার মুখোমুখি
 মোকাবিলার মধ্যে দিয়েই মাতৃভাষাকে নবজীবন দিতে না পারলে একুশের চেতনা আজও অধরাই রয়ে যাবে!
একুশ নিয়ে কাব্য নয়, একুশকে প্রতিদিনের জীবনযাপনে সত্য করে তুলতে হবে!





বর্ধমান ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.