রত্নদীপা দে ঘোষ

২০১২ আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের । এ কাঁপন শীতের শিহরণ নয় , এ কাঁপন নিজেদের মানুষ হিসেবে না চিনতে পারার জটিল ভয় । বছরটি শেষ হবার আগে ছুঁড়ে দিয়েছে প্রশ্ন ... সত্যি কি আমরা মানুষ হতে পেরেছি আদৌ এই একবিংশ শতাব্দীতে ...নাকি মানুষের বেশে আদিমের অস্থিবিশেষ !
১৬ ই ডিসেম্বর , নয়া দিল্লী ! প্রকাশ্য রাজপথে পড়ে থাকলো বছর তেইশের যুবতী... নগ্ন , প্রায় মৃত এই মেডিকেল স্টুডেন্ট গ্যাং- রেপের ফসল । কেঁপে উঠলো রাজধানী , আসমুদ্র হিমাচল । লক্ষ কোটি মোমবাতি না পারলো মেয়েটিকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে , না পারলো নিউক্লীয় বিদ্যুতে বলীয়ান ভারতবর্ষকে এতোটুকু আলোকিত করতে ...
এতো আর দ্বাপর যুগ নয় যে স্বয়ং ঈশ্বর অস্ত্র হয়ে বস্ত্র জুগিয়ে যাবেন অবমানিতাকে । এ আমাদের আলোকিত ভারত । মহান ভারত ! এখানে ঈশ্বর - টিশ্বরের অতো প্রয়োজন পড়ে না । নারী এই সমাজে স্বাবলম্বী , সার্থক এবং স্বছল । ঢাল তরোয়াল সহ নিধিরাম -পুরুষদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রয়োজন তাদের পড়েই না ! কিন্তু সত্যি কি তাই ? ঘুম থেকে উঠে কি দেখি আমরা ? কি শুনতে পাই ... গোঠের পোশাক অভিভাবকত্বে জর্জর মানবী , প্রেমের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডিতা মানবী ,অ্যাসিডে দগ্ধা মানবী , কন্যা ভ্রূণ হত্যা , পণপ্রথার মাশুল …… প্রতিরাতে স্বামীর হাতে খুন হয়ে যাওয়া ধর্ষিতা নিপীড়িতা মানবীকথন ! হেডলাইটের কোটর থেকে উঁকি মারে ছেঁড়া ব্লাউজ ...অসহায় রক্ত ।
আমরা সাধারণ মানুষ । আমরা রাজনীতি বুঝি না , আমাদের কারোর গায়ে কোনো ধর্ম - বর্ম নেই । আমরা শুধু জানি মেয়ে , আমাদের ঘরের মেয়েটি ...দু ' বিনুনী , রান্নাবাটি আর পুতুল খেলা মেয়ে ।এক নয় হাজার হাজার দামিনী , নিথর নগ্ন মৃত্যুতে মগ্ন অসময়ে হারিয়ে যায় , শুয়ে থাকে হিমঘরে , অসুখে নয় , অ - সুখেও নয় , পিশাচ তাণ্ডবের কারণে হিমঘরে শুয়ে থাকা মেয়েদের বয়েস বাড়ে না কখনো ...
এ শুধু শোক নয় , লজ্জা । অস্তিত্বের লজ্জা , চোখে চোখ রাখার লজ্জা ...হে মেরুদণ্ডহীন সমাজ ! শুধু লিঙ্গযোনি হয়ে আর কতোকাল উদ্ভ্রান্ত আদম রয়ে যাবে ! আমরা চাই , ২৬এ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে লজ্জায় গ্লানিতে অর্ধনমিত থাকুক ভারতের পতাকা । কোনো সাজসজ্জা নয় , আড়ম্বর নয় ...রক্তবীজের রাজনীতি নয় ... হারিয়ে যাওয়া দামিনীদের জন্য চোখের জল ফেলাও নয় ... আজ শুধু প্রচেষ্টা ! সূর্য ডোবার ঝুপসি অন্ধকার সরিয়ে , আগুনের চাপা আঁচে মানুষ হবার প্রবণতাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ...
আমাদের মুখের বলিরেখায় লেখা হোক একবার শেষবার মানুষ হবার প্রার্থনা ! গর্জনের মত ফুঁসে উঠুক দেশ , গনতন্ত্র , গবেষণাগার ... অশোকচক্রে জ্বলুক জলপিপাসু দামিনীদের লিরিক ! ধর্মের অহিফেন নয় , রাজনীতির কোকেন নয় , শুধু সৎ - শপথের এসেন্স ছড়িয়ে দিক জানুয়ারি ২৬ ......
'আজ যখন পশ্চিমদিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্তগহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল,
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তরের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে,
বলো "ক্ষমা করো'--
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।'
রত্নদীপা দে ঘোষ
কলকাতা
২০তম সঙ্কলনে পেয়ে গেলাম আমার প্রিয় কবি দীপাদিকে। কি অপূর্ব লেখার মাধুরজ্য। মন ছুঁয়ে গেলো। প্রতি ছত্রে পেলাম প্রতিবাদী ঝড়। ২০১২ সত্যি তো কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের। সুন্দর এক কবিতা দিয়ে শেষ ছত্রে আবার মনে করিয়ে দেওয়া-
উত্তরমুছুন"ক্ষমা করো" -- হিংস্র প্রলাপের মধ্যে সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।'