শ্রীশুভ্র









"প্রসঙ্গ যখন শিক্ষা!"



শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার! শিক্ষা গড়ে তোলে সুনাগরিক! সুনাগরিকের হাতে সুন্দর হয় সমাজ! রাষ্ট্রের উন্নতিতে যার ভূমিকা অনস্বীকার্য্য! ফলে এই শিক্ষা বিস্তারের সাফল্যের উপরই একটি দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি নির্ভরশীল! লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রথম বিশ্বের সমস্ত দেশে এই প্রাথমিক শর্তটি সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে! এই সব দেশে আজকে প্রায় সব মানুষই শিক্ষার আলোয় আলোকিত! সেই আলো সমাজের সর্বত্র সুফল ফলাতে কার্যকরি ভূমিকা নিয়েছে! সামাজিক উন্নতির ফল ভোগ করছে আপামর জনসাধারণ! আমাদের দেশের চিত্রটি একটু ভিন্ন! এ দেশে অধিকাংশ মানুষই শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত! শিক্ষার সুযোগ পাওয়া মানুষরাও শিক্ষার আলোকে সমাজে ছড়াতে তত সফল নন!

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ! তাই শিক্ষাকেই উন্নতকামী দেশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা উচিত! যেকোনো উন্নত দেশের শিক্ষা প্রসারের মাধ্যম মাতৃভাষা! কেননা মাতৃভাষা বাদ দিয়ে কোনো দেশে সার্বিক শিক্ষাবিস্তার সম্ভব নয়! নয় সার্বিক শিক্ষার উৎকর্ষতা অর্জন! একমাত্র প্রারম্ভিক শিক্ষা থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা সম্বলিত উচ্চশিক্ষার সমস্ত স্তর অব্দি শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হলেই; দেশের সার্বিক মেধার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব! তাছাড়া কিছু মানুষ তাদের মেধার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারলেও, দেশের অধিকাংশ মানুষের মেধাই বিকশিত হয় না! কারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য বই মুখস্ত করে পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো নয়! মেধার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো!


শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনুষত্বের পূর্ণ উদ্বোধন! আর সেটা সম্ভব হয় একমাত্র, মেধার সম্পূর্ণ বিকাশে!
কিন্ত মেধার সেই সম্পূর্ণ বিকাশ শুধুমাত্র অল্প কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে, জাতির উন্নতি হয় না! হয় না দেশের উন্নয়ণ! সেই কারণেই একটা জাতির যেটা প্রাণের ভাষা, তার মাতৃভাষা, সেই ভাষাতেই শিক্ষাবিস্তার একান্ত জরুরী! এই জরুরী বিষয়টাকে শিক্ষাবিস্তারের প্রথম শর্ত করতে হবে! এটি সর্ব কালেই সব দেশের পক্ষেই সর্বাংশে সত্য! দুঃখের বিষয় সেই প্রথমিক শর্তটিই এই বাংলায় আজ পর্য্যন্ত পুরণ করা হয়নি! হয়নি সক্ষমতার অভাবে নয়! হয়নি সদিচ্ছার অভাবে! হয়নি স্বাজাত্যবোধের অভাবে!

এখন ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে অনেকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির পক্ষেই যুক্তি সাজাবেন! এত ভিন্ন ভাষার দেশে সাধারণ ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব সর্বাধিক! এমনটাই তাদের যুক্তি! কথাটা ঠিক! কিন্তু সেটা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সত্য! শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সত্য নয়! কারণ শিক্ষার একটা দেশজ প্রকরণ আছে! যা দেশের সংস্কৃতির সাথে জলবায়ুর সাথে মনমানসিকতার সাথে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত! সেখানে কেরলের সাথে বাংলার মিল নেই! বাংলার সাথে কাশ্মীরের মিল নেই! কাশ্মীরের সাথে মিজোরামের কোনো মিল নেই! এই যে বিভিন্নতা এই বিভিন্নতাকে অস্বীকার করলে শিক্ষার সেই সার্বিক প্রসার ও মেধার সেই পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়!


এখন প্রশ্ন হল প্রতিটি রাজ্যে সেই রাজ্যের মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করতে পারলে, প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার সকল স্তরে সেই রাজ্যের ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার শর্ত পূরণ করতে পারলে সেই রাজ্যের সার্বিক মেধার বিকাশ নয় সম্ভব হল! কিন্তু এত বড় ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয়স্তরে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাই বা কি ভাবে হবে আর রাজ্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের সমন্বই বা কি ভাবে সংগঠিত হবে? এর একটাই উত্তর! মাধ্যমিক স্তরের পর দুই বছর আবশ্যিক ভাবে কমুনিকেটিভ ইংলিশ শেখানোর বন্দোবস্ত করতে হবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে! এটা খুবই সম্ভব!
এটির জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি শেখানোর কোনোই দরকার নেই!

অনেকেই ভাববেন মাত্র দুই বছরে কি এমন ইংরেজি শিখবে যে একেবারে ইংরেজিতে দিগ্বজ হয়ে যাবে? না ইংরেজিতে দিগ্বজ হবে না নিশ্চয়ই! হবার দরকারই নেই! কিন্তু ঐটুকু ইংরেজীতেই নিজের অধিত বিদ্যা অর্জিত শিক্ষায় সারা দেশের সাথে ও সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ সম্ভব! উদ্দেশ্য তো শুধু ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলতে পারা নয়? উদ্দেশ্য মানব সম্পদের উন্নয়ণ! উদ্দেশ্য সম্পদ সৃষ্টি! উদ্দেশ্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি! এবং সেই সাথে সারাদেশের ও বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ দৃঢ় করা! সেই যোগাযোগ ঐ কমুনিকেটিভ ইংলিশেই সম্ভব! বিশ্ব আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সুফল নিতে উৎসাহী! আমাদের ইংরেজী ভাষায় বুৎপত্তি নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ নেই!


অনেকেই সন্দিহান হবেন এই প্রস্তাবে! ঠিক, ভারতবর্ষের বর্তমান শাসন পদ্ধতিতে এই ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়! বিশেষ করে সম্পূর্ণ আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই কমুনিকেটিভ ইংলিশ সারা দেশের সব অঞ্চলে শিক্ষার বন্দোবস্ত করার মতো পরিকাঠামো বর্তমানে নেই! কিন্তু সে তো প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষাতেও; মাতৃভাষায় শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাও বর্তমানে কোথাও নেই! কিন্তু নেই বলেই অসম্ভব তা নয়! সম্ভব করার সদিচ্ছা নেই বলেই পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি! আমাদের সেই পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য  সমাজের সর্বস্তর থেকে সদর্থক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী! যে আন্দোলনের অভিমুখ হবে মানুষ গড়ার শিক্ষার সর্বিক প্রসার!

এখন প্রশ্ন হল, ভিনরাজ্যের অধিবাসীদের ছেলে মেয়েরা কোন মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এখানে বুঝতে হবে তারা ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশে গেলে কি হতো? না সেই দেশের মাতৃভাষায় শিক্ষার্জন করতে হতো! প্রথমে কিছু অসুবিধে হলেও সেই দেশের পরিবেশেই সময় মতো তাদের ভাষা সরগর হয়ে যেত! এবং এরকমই হয়ে থাকে! ফলে ভারতবর্ষের এক রাজ্যের ছেলে মেয়েরা অন্য রাজ্যে থাকলে সেই রাজ্যের ভাষাতেই লেখা পড়া করবে একই রকম ভাবে! এতো গেল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব! মজার কথা সকল উন্নত জাতিই এই নীতি অনুসরণ করে! কিন্তু ভূতপূর্ব পরাধীন দেশগুলিই শুধু শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়! আমরাও হয়েছি!


শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ডিগ্রী বিতরণ নয়! কিন্তু এইটিই আমরা ভুলে থাকি! পরীক্ষার পত্রে নম্বর তোলাই কৃতিত্ব বলে বিবেচিত হলে শিক্ষার মান অবশ্যম্ভাবি ভাবে নিম্নমুখী হতে বাধ্য! সেক্ষেত্রে একদিকে মুখস্থবিদ্যার চর্চা আর অন্যদিকে অসাধু উপায়ে নম্বর তোলার চর্চা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য! এতে ছাত্র ছাত্রীদের মৌলিক চিন্তা বিকাশের স্ফূরণ ঘটে না! ফলে মেধা সম্পদের বৃদ্ধি হয় না! এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে গেলে পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে হবে মৌলিক পরিবর্তন! যেখানে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত এমন জায়গায় আনতে হবে, যে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী শিক্ষকের সরাসরি মূল্যায়ণের আওতায় থাকবে! মেধার মূল্যায়ণটি জরুরী! বিকাশের জন্য!


শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকদের হতে হবে মানুষ গড়ার কারিগর!
স্কুল কলেজে লেখাপড়ার পদ্ধতিরও চাই মৌলিক পরিবর্তন! হোমটাস্ক দিয়ে প্রকৃত শিক্ষিত তৈরী হয় না! বিদ্যালয় শিক্ষকের প্রাইভেটে পড়িয়ে; পরীক্ষার বৈতরণী পাশ করাতে পারা যতদিন কৃতিত্ব বলে বিবেচিত হবে ততদিন মৌলিক মেধার বিকাশ সম্ভব নয়! শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারী ব্যায়বরাদ্দ বাড়াতে হবে! শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করা সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে! মাধ্যমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ছাড়া সর্বিক শিক্ষার বিস্তার অসম্ভব! মানুষ গড়ার শিক্ষাকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক মর্য্যাদা দিতে হবে! শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য হোক স্বদেশের উন্নয়ণ!

বর্ধমান ।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

সুচিন্তিত মতামত দিন