এ বি এম সোহেল রশিদ







উচ্চারণ
~~~~~~~~~~~~~~



ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ। দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরছেন। হাতে একটা সাদা কাগজ। একটা দরখাস্ত লিখতে হবে। যাকে মনে ধরছে তাকেই বলছেন “ভাই আমারে একটা কাগজ লেইখ্যা দেন না ভাই’কারও একটু সময় নেই। সবাই ব্যস্ত।ব্যস্ত শহর । তার উপর হাসপাতাল। এখানের মানুষ গুলো দরকারের চেয়ে বেশী ব্যস্ত। দালালের ভীর লেগে আছে। টাকা দিলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।তখন কোন নিয়মই আর নিয়ম থাকে না। এ দৃশ্য দেখছিলাম আর সময় কাটাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করলে আমিও লিখে দিতে পারি। কিন্তু কি দরকার ঝামেলা কাঁধে নেয়ার। পরোপকার বিষয়টাই কেমন যেন অলসতা ও অনিচ্ছার জালে বন্দী। শহুরে জীবনে আমাদের মানবতা ও বিবেক শৃঙ্খলিত হয়ে গেছে। 
সময় আর নিয়তি তো আর নিজের ইচ্ছেমত চলে না। বৃদ্ধটি শেষ পর্যন্ত দরখাস্ত লেখার জন্য আমাকেই বেছে নিলো।
চাচা মিয়া আমারে একটা উপকার করবেন। 
কি বলেন?
আমারে একটা কাগজ লেইখ্যা দেন।
হাসপাতালে দরখাস্ত দিয়া কি করবেন?
ছোড ডাক্তার কইল বড় ডাক্তারের কাছে একটা কাগজ দিলে তয় ছাড়বো?
কি ছাড়বো।
আর কইয়েন না চাচা মিয়া আখাউড়া হাসপাতাল থেইক্যা কইল ডাহা লইয়া গেলে বালা আইব। হেগো কথা মত আইলাম। এহানে মাডির মধ্যা ফালাইয়া রাখছে । আজকা লইয়া সতের দিন। টাহা ছাড়া কোন চিকিৎসা নাই। খালি সুই লেইখ্যা দেয় বাইরের থেইক্যা কিন্না আনুন লাগে। টেবলেট ছাড়া কিছুই দেয়না। নামে সরকারী হাসপাতাল। কামে পেরাভেট ( প্রাইভেট) হাসপাতালের চেয়ে খারাপ। টাকার টাকাও গেল । সময়ও গেল । মাইয়া আমার কষ্টে কুকড়াইয়া গেছে। 
আইচ্ছা কোন আমার মাইয়া আমি আমি লইয়া যামু তাও বলে কাগজ লেইখ্যা লইয়া যাইতে হইব। এইডা কোন দেশের বিচার। 
চাচা এটা নিয়ম । নিয়মতো মানতে হবে।
নিয়মের কতা কইয়েন না চাচা মিয়া। নিয়মতো অনেক কিছুই আছে। হাসপাতালে সিট দিব। ঔষধ দিব। চিকিৎসা দিব। খাবার দিব। কোনডাই নিয়ম মাইন্না দেয়। খালি গরীবের বেলায় নিয়ম।
কি উত্তর দিব। গায়ের লোক হলেও বয়সের সাথে অভিজ্ঞতাও বেড়েছে।পোড় খাওয়া মানুষ গুলো এমনই। দারিদ্র্যতার কাছে শিখেছে অনেক।কি উত্তর দিব। এর উত্তর আমার জানা নেই। উত্তর আছে নিশ্চয়। । কিন্তু ঐ যে বিবেক আর মানবতা অলসতার জালে বন্দী।কারও ঝামেলা কেউ নিতে চায় না। এই যে এই বৃদ্ধ একটা দরখাস্ত লিখতে এর দুয়ারে ওর দুয়ারে ঘুরছেন। কেউ লিখে দিচ্ছে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরছেন। কারও সময় নেই। 
আচ্ছা চাচা মিয়া কি লিখতে হবে বলেন। 
চাচা আমি যদি জানতাম তাইলে কি আর এহনও বইস্যা আছি । 
না মানে কাকে লিখব কি কারণে চলে যাবেন তা উল্লেখ করতে হবে না। 
ও বুচ্ছি । একটু কষ্ট কইর্যা আসেন আমার লগে ।ছোড ডাক্তার আফনারে বুঝাইয়া দিব। 
অনিচ্ছা স্বত্বেও গেলাম।
স্লামালাইকুম।
ডাক্তার না তাকিয়ে বেলল বলুন । 
এই চাচার কি সমস্যা । কাকে এড্রেস করে দরখাস্ত লিখতে হবে। 
ডাক্তার চোখ তুলে তাকায়। চাচাকে দেখেই রেগে গেলেও সম্ভবত আমাকে দেখে রাগ সামলে নেয়। ওর অঙ্গ ভঙ্গি দেখে এটা ঠিক বোঝা যায়। 
চাচা আপনার যেন কি সমস্যা? 
কি কন ডাক্তার সব আফনে বেবাক ভুইল্যা গেলেন।আমার মাইয়া বারান্দার উত্তর পাশে মাডিত সতের দিন ধইরা শুইয়া আছে । হেরে আমি বাড়িত লইয়া যাইতে চাই।আফনে না কইলেন কাগজ দিয়া লইয়া যাইতে। আমি ওনারে বহুত কইয়া রাজি করাইছি। উনি লেইখ্যা দিব।
ও এর জন্য তো আমাদের নির্দিষ্ট ফরম আছে। ওখানে লিখে নিয়ে গেলেই। হয় । 
তা তো আমারে কন নাই। আমারে কইছেন কাগজ লেইখ্যা আনতে। 
তর্ক বেড়ে যাবে দেখে আমি বললাম ফরমটা দিন আমি লিখে দিচ্ছি। 
আপনি ওনার কে হন। ?
কেউ না।
আমাদের বিষয় আমরা দেখছি। 
না। আমি যখন এসেছি আমি কাজটা শেষ করে দিয়ে যেতে চাই। প্লীজ ফরমটা আমাকে দিন। 
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবল কে জানে?বলল ঠিক আছে। আমিই করে দিচ্ছি । 
আমি চাচাকে বললাম। চলেন আপনার মেয়েকে দেখে আসি।
চলেন চাচা মিয়া
ঔষধ আর পচা গন্ধে বমি আসার যোগার । এর নাম হাসপাতাল। ভাল মানুষ এখনে কিছুক্ষণ থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে চাচার পিছু হাটতে হাটতে বারান্দায় চলে এলাম । এখানের অবস্থা আরও করুন। মনে হল ফুটপাতে শুয়ে আছে । কি করুন দশা! এই আমাদের মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন। আঁতকে উঠা ছাড়া কি আমাদের কিছুই করার নেই। 
এই হল আমার মেয়ে। 
পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে অবহেলায় মেঝেতে শুয়ে আছে।। অসুস্থ যে বোঝার উপায় নেই। 
কি অসুখ। পেটে ব্যথা। বহু ডাক্তার কবিরাজ দেখাইছি। কোন লাভ অয় নাই। একবার কয় টিউমার আরেকবার কয় ক্যানসার। আবার কয় টিবি। আসলে যে কি ।আল্লায় জানে।
এতক্ষনে নার্স কাগজটা নিয়ে এসেছে। । অবাক হলাম এদের তড়িৎ গতিতে কাজ করা দেকে। নার্সকে জিঞ্জেস করলাম। এর রোগটা কি ।
নার্স যা বললো তার অর্থ হল । এর পেটে ছোট একটা টউমার আছে। এটাতে টিবি বাসা বেঁধেছে। এখন টিবির চিকিৎসা চলছে। ডাক্তাররা আশঙ্কা করছেন টিউমারটিতে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি আছে কি না দেখছেন। থেকে ক্যান্সার হতে পারে। তাই অপারেশন না করে অবজার্ভ করা হচ্ছে। বিষয়টি জটিল তাই সময় লাগবে।বলে চলে গেল নার্স।
মেয়েটির বয়স কত হবে? ত্রিশ এর কাছাকাছি। 
জিজ্ঞাস করলাম কি নাম তোমার ।শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। দেখলাম দুচোখে মুক্তোর দানার মত দু’ফোটা অশ্রুবিন্দু। 
চাচা মিয়া হে কতা কইতে পারে না । জন্ম থেইক্যা বোবা। মুক্তিযোদ্ধার মাইয়া কতা কইতে পারে না। এক দিক দিয়া বালাই অইছে। কতা কইতে পারলে জিগাইতো আমারে ““বাবা কেন যুদ্ধ করছ? এই কি তোমার স্বাধীন দ্যাশ। কি উত্তর দিতাম আমি কও।

আমি চাচাকে বললাম । বাড়িতে নিয়ে কি করবেন। 
বাবা ঢাকা শহরে যা লইয়া আইছিলাম সব শেষ।মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে ভাতা পাই তা দিয়া সংসার আর চলে না। ভাষার লাইগ্যা সংগ্রাম দেহি নাই। কিন্তু দেশের লাইগ্যা যুদ্ধে যাইয়া এইডা বুঝছি ভাষার লাইগ্যা সংগ্রাম কেন দরকার আছিল। ভাষার নামে দেশ বলেন চাচা আর কোন জায়গায় আছে। 
মেডিকেলের ঐ ধারে শহীদ মিনার । দেখলাম সবাই এহানে আইসা বড় বড় কতা কয়। কেউ কেউ আমাগো বোকা ভাইব্যা মিথ্যাও কয়।বলেন চাচা এইডা কি ঠিক। যেখানে কথা বলা দরকার সেখানে কেউ কতা কয় না ।মায়ের ভাষায় কতা কই কিন্তু এই ভাষার মানুষ গুলার লাইগ্যা কি আমাগো কারো কোন কিছু করার নাই?
আমার মাথায় আর কিছুই ঢুকেনা । ভাবতে থাকি। দেশের লাইগ্যা যে যুদ্ধ করছে তার প্রজন্ম জন্ম থেকে কথা বলার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। দরিদ্রতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে । এ বোবা মেয়ে তো আমারে দেশের প্রকৃত রূপ। দেশ আমার অপরূপা! সুন্দর! কিন্তু দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার দানবের কাছে নতজানু। যে ভাষায় আমাদের কথা বলা উচিৎ সে ভাষায় কি আমরা কথা বলছি। প্রতিবাদ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মায়ের ভাষা। তার কতটুকু মর্যাদা আমরা দিতে পেরেছি।? 
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অর্থ সাহায্য করার ধৃষ্টতা আমার হল না। আমি তার কাছে অপরাধী। । তারা যে বাংলাদেশ চেয়ে ছিল তা আমরা দিতে পারিনি।মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলে এলাম। আমরা কাপুরুষ! আমরা এখন সবাক বোবা।
কোথায় হারিয়ে গেছে সেই উচ্চারণ। এর উত্তর খোঁজা এখন খুব জরুরী... খুব জরুরী।
এমন সময় নার্স এসে বলল কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে।অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও তাকে কাঁদানো যায় নি!

ঢাকা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.