
সৌজন্য - প্রথম আলো
নীরব যন্ত্রণা !
আজ বিকাল থেকে বেশ গরম বাতাস বইছে। আকাশ জুড়ে কালো মেঘ সেই সাথে মাঝে মাঝেই গুড়ুম গুড়ুম শব্দ জানান দিচ্ছে এখনই বৃষ্টি হবে। মেঘের কারনে সন্ধ্যা হবার আগেই আঁধার নেমে এসেছে। এমন দিনে মনের পাতায় ভাসে শৈশবের কিছু স্মৃতি। মনে পড়ে ফাগুনের আগুণ ঝরা বাসন্তী সাঁজ আর আম কুড়ানোর আনন্দঘন উল্লাস।
আজ এই মেঘলা সন্ধায় সদ্য মহল্লায় আসা মনোয়ারা বেগমের মনটা খুব খারাপ লাগছে। আজ পাড়ার জাকির সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ে। কি সুন্দর রঙিন ব্যানার সাজিয়েছে ছাঁদে। তিনিদিন ধরে রঙ বেরঙের রঙিন বাতি জ্বলছে আর নিভছে বাড়ীর চারিদিকে।
প্রতিদিন এমনই মেঘ হয় বাদ্য বাজে কিন্তু বৃষ্টি হয়না। আজ মেঘ আর বাতাসের বেগ দেখে মনে হচ্ছে শুধু বৃষ্টি না ঝড় হবে। আর তাই মনোয়ারা বেগম বার বার আল্লাহকে ডাকছে যেন আজও প্রতিদিনের মত বাতাস আর বিদ্যুৎ জমকে মেঘ যেন কেটে যায়। অস্থিরতায় বারবার হেঁটে গেইটের কাছে যাচ্ছে সে । আর পথের দিকে তাকিয়ে ঐ বাড়ীর হালচাল বোঝার চেষ্টা করছে। বাতাসকে ভারী করে পাড়াময় বিরিয়ানীর সুগন্ধ মৌ মৌ করছে। বাসার ছেলেমেয়েরা সাঁজ সজ্জা করে রেডী হচ্ছে বিয়ে বাড়ীতে যাবে বলে।
মনোয়ারা বেগমের বাড়ীর সামনে ফাঁকা মাঠ এবং এই মাঠের মাঝেই বেশ বড় একটা নিমগাছ। প্রচার আছে এই গাছে আছে ভুতের বাস! যদিও কোনদিন কেউ দেখেছে বলে স্বীকার করেনি। তবে মনোয়ারা গভীর রাতে গাছের মগডালে টিমটিম বাতি জ্বলতে দেখেছে। এই কথা সে স্বামীকে ছাড়া আর কাউকেই বলেনি। স্বামীকে বলার কারন সে অনেক রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরে। সে যেন এই গাছের আশপাশ দিয়েও না আসে। স্বামী সফেদ আলীও জানে এই গাছে কিছু একটা আছে তবে সেইটা ভুত কিনা সে জানেনা।
একদিন রাত এগারোটার দিকে সে বাসায় ফিরছে। সেদিন বেশ কুয়াশা পড়েছে সাথে শীতও বেশ। কাশ্মীরি শালটা দিয়ে মাথা মুখ একেবারে ঢেকে বাসায় আসছে। নীম গাছটা থেকে একটু দূরে আসতেই একটা শীতল অনুভব তার শরীরে খেলে যায়। সে দেখে নীম গাছ থেকে একটা সাদা বিড়াল নেমে মাঠে নেমে হাঁটছে। সফেদ আলীর পা দুটো কে যেন রাস্তার সাথে বেঁধে রেখেছে। সে চায়ছে সামনে যেতে কিন্তু পারছেনা। চোখের পলক ফেলে তাকাতেই দেখে মাঠে বিড়াল নেই! একটা সাদা ঘোড়া ঠকঠক আওয়াজ তুলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে হাড় কাঁপানো শীতেও সে ঘামতে শুরু করেছে। হাতের টর্চটা জ্বালাতে গিয়েও পারল না। বিড়বিড় করে সমানে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন’ গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
-সফেদ আলী সাহেব কি করেন এখানে দাঁড়িয়ে?’ কথাটা বলে গায়ে হাত দিতেই আঁতকে উঠে সম্বিত ফিরে পায় সে! পিছনে তাকিয়ে দেখে জাকির সাহেব।
-‘কী হয়েছে ভাই সাহেব? কতবার ডাক দিলাম আপনার কোন সাড়া শব্দ নেই’!
‘-না না কিছুনা’ কথাটা বলে লজ্জা পায় । এবার হেসে দেয় জাকির সাহেব
‘-এগিয়ে দেব, নাকি একাই যেতে পারবেন?’
-‘হ্যাঁ ভাই যেতে পারব’। জাকির সাহেব মৃদ্যু হেসে চলে যায় মুখে কিছুই বলেনা।
বাসায় এসে অবশ্য সফেদ আলী কাউকে কিছুই বলেনি। এমন কি স্ত্রী মনোয়ারাকেও না। আর তাই স্ত্রী যখন সাবধানে আসার কথা বলে তখন সে মুখ টিপে শুধু হেসে যায়।
ঝড় বৃষ্টি কিছু না হলেও দমবন্ধ হয়ে যাবার মত করে গুমোট গরম পড়েছে। ভালই ভালই বিয়ে হয়ে গেছে মেয়েটার। আজ কতদিন ধরে যেখানে পাড়াময় আনন্দ বয়ে গেছে সেখানে এখন বিষাদের ছায়া। মেয়েটা যেন জাকির সাহেবের একার ছিলনা ছিল মহল্লার প্রতিটা ঘরের আদরের ধন। মনোয়ারাও কেঁদে কেটে একাকার। দশ মিনিট হল বাসায় এসেছে। কিন্তু মনটা ভীষণ অশান্ত হয়ে আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়ে বিদায়ের শোক ঐ আকাশকেও শোকে মাতিয়েছে। লাল হয়ে আছে আকাশটা।
একটু আগে বেশ জোরে বাতাস হয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না। বারান্দায় বসে নানা কথা ভাবতে ভাবতে সে তাকায় সামনে মাঠে্র উপরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নীম গাছটার দিকে।
গাছটাকে আজ অনেক বড় মনে হয় । একেবারে উপরে মনে হয় কালো ঘন কাপড় দিয়ে কেউ ঢেকে দিয়েছে। মনোয়ারা পলকহীন তাকিয়ে থাকে। দেখে কালো কাপড়টা ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসছে। কি করবে ভেবে পেলনা। কারেন্টও নেই যে আলো জ্বালবে। সে দেখে বড় বড় বেশ কয়েকটা চোখ জ্বলজ্বল করে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। মনে হচ্ছে এখুনি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ভয় শিরশির করে সারা দেহে চড়ে বসেছে। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে! এমন সময়ে রাস্তা থেকে ছোট্ট একটা বাচ্চার চিৎকার ভেসে আসে
-এইডা আমার খাবার আমি দেব না, না আমি দেবনা
মনোয়ারা ভয়কে তাড়িয়ে ছুটে যায় গেইটের কাছে । দেখে দশ বারো বছরের একটা ছেলে একটা সিলভারের ডিশে খাবার নিয়ে ঘুল্লি খাচ্ছে। ডিশটা একবার বামে একবার ডানে নিচ্ছে আর চিৎকার দিয়ে বলছে এ খাবার তার সে কাউকে দেবেনা। সে ছেলেটাকে ধরে রাখে দুহাত দিয়ে কিন্তু তাও ছুটে যেতে চায়। জোরে ঝাকি দিতেই ছেলেটা হুশ করে নিশ্বাস ছেড়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকে বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে যায়। বাসার সবাই মনোয়ারার চিৎকারে জেগে উঠে। টর্চের আলোয় সবাই দেখে ছেলেটা তখনও ভাতের ডিশটা শক্ত করে ধরে আছে।
জ্ঞান ফিরতেই ছেলেটা বলে সাদা দুইটা হাত ওর বিরিয়ানীর ডিশটা নিয়ে টানাটানি করছিল। আজ কতদিন ধরে ওর অসুস্থ মা বিরিয়ানী খেতে চেয়েছে কিন্তু সে দিতে পারেনি। আজ এই বিয়ে বাড়ীর খবর পেয়ে সে সেই বিকাল থেকে অপেক্ষা করে, কিছু কাজ করে এই খাবারটুকু পেয়েছে। সে এই খাবার কাউকেই দেবেনা। বুকের সাথে জাপটে ধরে খাবারের ডিশটা। মনোয়ারা স্বামীকে বলে ছেলেটাকে বাসায় পৌছে দিতে।
ঘটনাটি প্রচার পেতে কয়েক ঘন্টা সময় নেয়। পরেরদিন মহল্লার সবাই সিদ্ধান্ত নেয় নিমগাছটি কেটে ফেলা হবে। নির্ধারিত দিনে গাছটি কাটতে গিয়ে সবাই অবাক হয়ে দেখে গাছের ডালগুলো গতরাতে দুমড়ে মুচড়ে মহা তাণ্ডবে ভেঙে দিয়ে গেছে। দুজন মওলানা দোয়া দরুদ পড়তে থাকে আর একজন কাঠুরিয়া গাছটাতে কোপ দিতেই হালকা লাল পানির মত বের হয়। মহল্লার সব মানুষের সামনেই একসময় গাছটা কেটে ফেলা হয় কোন রকম বাঁধা ছাড়ায়।
এলাকার সবচেয়ে পুরানো বাসিন্দা আকমল সাহেবের চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরে। মেয়েটা সারাদিন পড়াশুনা বাদ দিয়ে শুধু দুষ্টুমি করত আর বান্ধবীদের সাথে ঘোরাফেরা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। রেজাল্ট খারাপ করেছে বলে আকমল সাহেব সেদিন বেশ করে বকা দেয়ায় আজ থেকে দশ বছর আগে এই গাছেই দড়ি লাগিয়ে অভিমানী কিশোরী মেয়েটা ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। সেই থেকে মাঝে মাঝেই এমন কিছু ঘটনা তারা দেখেছে যা অবিশ্বাস্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত কারো কোন ক্ষতি কোনদিনই হয়নি।
-বোকা মেয়ে, এখনো তোর চঞ্চলতা কমেনি! কমেনি সবাইকে ভয় দেখানোর অভ্যাসটাও! কথাটা ভাবতে ভাবতেই নুয়ে পড়া আকমল সাহেব ধীর গতিতে হেঁটে যায় সামনের দিকে...।
সুচিন্তিত মতামত দিন