মৌসুমী সেন



                                                                                      ছোট গল্প 






" অব্যক্ত আর্তনাদে আয়ুষ্কাল "



আজকের সকালটা হৈমন্তী'র একেবারেই অন্যরকম।
ভেবেছিল হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলবে সূর্য সকালের রঙ। আসলে ভাবনার গভীরতা কখনো কখনো বিপরীত রীতি অনুসরন করে। মনের আকাশে কিছুটা বিষাদ নিয়েই স্নান সিক্ত চুলে পূজোর থালা হাতে দীপ জ্বালতে গিয়ে অঝোর প্লাবনে সিক্ত হল হৈম !
কেন, কি কারন জানতে পারলাম না !
পাছে তার ঈশ্বর আরাধনার চ্যুতি ঘটে যায় সে আশঙ্কায় প্রশ্ন থেকে বিরত থাকলাম। শুনতে পেলাম ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা, আর বলছে 'হে প্রভু' তুমি আমায় আরও দুঃখ দাও, যাতে করে তোমার দুয়ারে অশ্রু প্লাবনের নদী বইয়ে দিতে পারি, তোমার চরণ ধুইয়ে দিতে যেন কোন সরোবরের আশ্রয় নিতে না হয়। অঝোরে ঝরে যাওয়া বিলাপে দুঃখ চাওয়া ছাড়া আর কিছু তো চাইবার নেই। পারো'তো আমার আয়ুসন্ধি বাটোয়ারা করে স্বামী সন্তানদের দীর্ঘায়ু করে দিও। আমার অবর্তমানে আমার সন্তানদের তুমি দেখ মালিক।

অশ্রু প্লাবনে ভাসতে দেখে হৈম'র কাছে জেনে নিলাম তার কষ্ট কারণ। জেনে নিলাম ঈশ্বর নামে ঈশ্বরবাদের ভাগ্যলিখন। নির্ধারিত সময়ের হিসেব নিয়েই নাকি ঈশ্বর হৈমন্তিকে বিধিলিপিতে বেঁধেছেন। আত্মীয় পরিজনের বুকে বেঁধে আছে সে বিশ্বাসের স্তর। ক্ষণ-জন্মবাদের হিসেব চুকিয়ে দেবার সময় হৈমন্তীর হাতে নাকি একেবারেই কম !
জন্ম বিশ্বাসে ঈশ্বর ঠিকুজি নির্ধারণে ধর্ম নামের সাধক মহর্ষি। যারা এই জন্ম ভূমিতে জন্ম সূত্রের আলামতে এনেছেন হৈমকে, হৈম'র বিশ্বাসে তারাই স্রষ্টা-পালনকর্তা-লালনকর্তা। তারা স্বর্গবাসি হয়েছেন।
"হৈম'র আয়ূসন্ধির জন্য প্রার্থনারত শুভার্থী কেউ নেই"!

পরিজনেরা দুঃখ প্রকাশে হৈমকে শান্তনায় পিঠে হাত বুলায়, কি আর করা বাপু, নির্ধারিত সময় তিনি দিয়েছেন, তুমি কি করে তা এড়িয়ে যাবে বলো ? হৈম'র মনে হয় তাকে বিদায় দেবার জন্য এই শুভার্থীরা পূর্ণ প্রস্তুতিতে দিন গুনছে সময় সন্ধিক্ষনের। তবু হৈম প্রার্থনায় নত হয়ে অলক্ষ্যে থাকা শক্তি, "স্রষ্টার" উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে যায় আজকের পরের বাকি আয়ুটুকু আমার প্রিয় সন্তান স্বামীকে দিয়ে ওদের দীর্ঘায়ু করো প্রভু।

"এই তো নারী চরিত্র, যেন দানের মাঝেই নিজেকে প্রকাশ করা" !
নারী হয়ে জন্ম নেবার অপরাধে নিয়মের সূত্র ধরে পরিবার ছেড়ে, পরিজনে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে
বীজপত্র ধারনে নিজেকে স্বীকৃত নারী করার অন্তলীলায় বন্ধন উজ্জ্বলতার স্বাক্ষ্যে বংশ বৃদ্ধির অঙ্গিকারে আবদ্ধ। আয়ুস্কাল ক্ষণকালের নিরূপনেও হৈম'র সৌহার্দসঙ্গী নেই। আত্মশুদ্ধিতে দূর্ভাগ্য নয়, হৈম নাকি সৌভাগ্যবতী নারী !
"স্বামীর ঠিকুজীতে হৈম'র আয়ুষ্কাল নির্ধারিত" !

হৈম'কে এই সৌভাগ্যের আশীর্বাদে শ্বশুরকুলের মানুষ লক্ষ্মী নারায়ণী ভাবে। বিদায় নেবে হৈম পৃথিবী থেকে, হাতে আর খুব কম সময় ! হৈম না থাকার কারণে যেন তার সন্তান, স্বামী ভেঙ্গে না পড়ে, অসুস্থতায় নিজেদের না ভোগায়, সে প্রস্তুতিতে স্বামী-সন্তানদের মঙ্গল আরাধনায় তাদের আয়ূ বৃদ্ধির জন্য মৃত সঞ্জীবনি তাবিজ দিয়ে আয়ুরেখা দীর্ঘ হবার প্রচেষ্টায় স্বজনরা উদ্‌গ্রীব !
হৈম অবাক হয়ে ভাবে অনিয়মের এই নিয়ম ! যার আয়ুষ্কাল স্বামীর ঠিকুজীতে নির্ধারিত, সেই পরিবারে তার জন্য নেই কোন প্রস্তুতি ! হারানোর আহাজারি, তার অবর্তমানে স্বামী-সন্তানের সুস্থ দীর্ঘায়ু কামনায় পরিবারের আহুতি !

এ কেমন নির্ধারণ ?
এই পরিবারে শুধু বংশবৃদ্ধি আর প্রয়োজনের আসবাব'ই কি ছিল হৈম এতদিন?
কষ্টের এই মিনতি হৈম কাকে বলবে? উদাসি স্বামী টাকা আয়ের মেশিন, টাকা ছাড়া যেন ভবিষ্যতের কোন হাতছানি তাকে ডাকেনা ! পরিজনরা হৈমর অনুপস্থিতে কে কোন অবস্থানে নিজেকে মানিয়ে নেবে সে প্রস্তুতিতে প্রতিদিন হৈমকে বিদায় জানায় ঠিকুজী নির্ধারিত গল্পে।
হৈম'র জীবনের এই করুন আত্মকাহিনী আজও বাংলার নারী চরিত্র রূপায়নে !
হায়রে নারী, এত করেও পরিজনদের স্বজন হতে পারেনী !
"এই তো নারী" !
এভাবেই নারীর অবস্থান আর কত ?
কতদিন আর বোবা কান্নায় নিজের জীবনের ইতিহাস গোপন রাখবে,
আর কত নিপীড়ন সহ্য করে দেবে ধৈর্য্যের পরীক্ষা ?
নারী কি যুগে যুগে আসবাব'সম শুধু ঘড়ার জলেই-
শুদ্ধ ব্যবহারে ব্যবহার্য হবে ?!!


চট্টগ্রাম ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

সুচিন্তিত মতামত দিন