
বাংলা সাহিত্যে অবিদ্যা
“নারী সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী’ (ভার্জিনিয়া উলফ)।

রাহুল সংস্কৃত্যায়নের ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা’ বই থেকে জানা যায়, রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে যে আদিম মানব সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল তা ছিল পুরোপুরি নারী কেন্দ্রিক;- নারীরা শিকারসহ যাবতীয় সাংসারিক কাজে নেতৃত্ব দিত। সময়ের সাথে পালাবদল ঘটল, শারিরীক ভাবে অপেক্ষাকৃত অধিক সবল পুরুষদের প্রাধান্য দিয়ে গড়ে উঠল পুরুষ কেন্দ্রিক সভ্যতা। ইতিহাস সাক্ষী যে, ‘মাতৃ-অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। ’দলনেত্রী বা পরিচালিকার পদ থেকে বিচ্যুতি ঘটে নারী উঠে গেল ভোগ্য পণ্য তালিকার শীর্ষস্থানে। কাদের ভোগ্যপণ্য ? উত্তর জলের মত সোজা। বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পুরুষের বহুগামিতার জন্য বহুগামী নারীর প্রয়োজন অপরিহার্য। যেহেতু সাধারণভাবে পরিবারের অন্তর্গত নারীর সাথে পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত অবাধ গমন ব্যাপকভাবে সম্ভব নয়, তাই পুরুষের এই বহুগামিতা সম্ভব করার জন্য উদ্ভব হয়েছিল প্রায় খোলাখুলিভাবে রক্ষিতা রাখার ব্যবস্থা (hetaerism)। কিন্তু সেটার প্রচলন তেমন ব্যাপক হওয়ার পথে বাঁধা অনেক। কাজেই একবিবাহ প্রথায় পুরুষের বহুগামিতা সম্ভব করার জন্য উদ্ভব হয়েছিল পতিতাবৃত্তির। আসলে মানুষের তৈরী করা সমাজ নামক কাঠপুতলীটির ভিতর অনেক কিছুই আশ্রিত,তার মধ্যে অবিদ্যারা বা পতিতারা বা বেশ্যারা একটি পরিচিত অঙ্গ। অথচ বিশ্বের এমন কোন সমাজ নেই , এমন কোন দেশ নেই যেখানে পতিতা বা বেশ্যা নেই, অনেক জায়গায় তো একে ‘পৃথিবীর আদিমতম বৃত্তি’ বলেও দাবী করা হয়। কারনটি সহজেই অনুমেয়।
অবিদ্যা, ‘সরস্বতীর ইতর সন্তান, রূপোপজীবীনী, গনিকা, বারাঙ্গনা, বারবণিতা, পতিতা, সামুহিক ভাবে এবং এককভাবেও আমাদের সকলের কাছে একটি ঘৃণ্য ,অস্পৃশ্য বা একটি কলুষিত নাম। আমরা যারা ভদ্র সমাজের বাসিন্দা, তারা তার নাম শুনা মাত্রই আঁতকে উঠি, তার নাম শুনে আমাদের কারো কারো জাত যায়, কেউ কেউ অপবিত্র বোধ করি। কেননা,সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় শুধু নারীকেই। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখি কেন সে বারাঙ্গনা হলো, কে তাকে বারাঙ্গনা বনালো, কে তাকে ঠেলে দিলো এই অন্ধকার পথে? না আমরা তা কখনো ভাবিনা। কারণ তা ভাবার আমাদের কোন দরকার নেই, সময় নেই। বরঞ্চ বটতলার সাহিত্য চর্চায় মূল উপপাদ্য হয়েই পতিতাসমাজ ও তার আবাসিকরা বারবার উল্লেখিত হয়েছে। অবিদ্যাদের সাথে বিদ্যাজগতের প্রথম সংস্পর্শ এখান থেকেই ধরা যেতে পারে।
সাহিত্যের মাঝে চিরন্তন বস্তু থাকে বলেই তা কালের সীমানা পেরিয়ে যুগ থেকে যুগান্তরেও বিস্তার লাভ করে, সুতরাং বলা যায় সাহিত্য চিরন্তন, খাঁটি ও অকৃত্রিম। সমাজের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তবে সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলার আগে শুরুতেই জেনে নেয়া যাক সাহিত্য কি? মানুষের অনুভূতি, কল্পনা, সৌন্দর্য ও ভাবনা প্রভৃতির মূর্ত প্রকাশই হচ্ছে সাহিত্য। মানুষ সামাজিক জীব কেননা মানুষ ও তার সকল কার্যকলাপ সমাজের অর্ন্তভুক্ত। মানুষের মনের পরিশীলিত চিন্তাভাবনা; ঘটনাপ্রবাহের আবর্তে ঘটে যাওয়া অন্যের বাস্তবতাকে যখন একজন কবি, সাহিত্যিক কিংবা উপন্যাসিক নিজের মনের মত করে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকাশ করে তখনই তা সাহিত্য হিসাবে পরিগনিত হয়। মানুষ তার মনের ভাব অন্যের মনে সঞ্চারিত করতে চায়। অন্যের হৃদয়ের সাথে মিশে একাকার হওয়ার কামনায় মানুষ সাহিত্য সৃষ্টি করে। সাহিত্য হচ্ছে মানব মনের সুপ্ত আবেগের কথা। সাহিত্যকে সমাজের দর্পন স্বরূপও বলা যেতে পারে। সাহিত্য পাঠে জনগণ সচেতন হয়, জনমতও গড়ে উঠে। তাই সাহিত্যের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা পরিপুষ্টি লাভ করে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, আপামর জনসাধারনের রোজকার জীবনধারনের কাহিনী, দৈনন্দিন ঘাত প্রতিঘাত, হাসি কান্না, মিলন বিরহ,সামাজিক বা আর্থ সামজিক অবক্ষয়,ধর্মের বিধিনিষেধ,কুসংস্কার,ভালো মন্দ সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন সাহিত্যমনস্ক জনের লেখনীতে। সেইভাবেই বাংলা সাহিত্যে “অবিদ্যা” বা “পতিতা”প্রসঙ্গটিও বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে।
ভারতবর্ষীয় সমাজে পতিতাবৃত্তির চল যে বহুকাল থেকেই ছিল নানা সূত্রে তার পরিচয় পাওয়া যায়। শাস্ত্রে-ধর্মে-সমাজে এই প্রথার এক ধরনের স্বীকৃতি জুটেছিল। ঋকবেদ, অথর্ববেদ, যজুর্বেদে পতিতাদের প্রসঙ্গ বহুবার এসেছে। শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের তার সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার নানা তাম্রশাসন ও লেখমালায় সংগীত-নৃত্যপটিয়সী রাজনটীদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও নারীসমজের অচ্ছুত এই অংশকে অনেকসময়েই বাধ্য হয়ে পতিতার জীবনযাপন করতে হয়েছে। ‘দেবদাসী’ প্রথা তার একটি বড় দৃষ্টান্ত। এরওপর কালীঘাটের পটচিত্রের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনি অনেক মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য মেলে।
বহুকাল ধরেই বাঙালি সমাজে পতিতাদের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অতএ, বাংলা সাহিত্যেও পতিতা যে একেবারে অপাঙক্তেয় ছিল তা নয়। মধ্যযুগ থেকেই পতিতার প্রসঙ্গ ও পরিচয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। গোপীচন্দ্রের গান, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল, দোনা গাজীর সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস- এইসব নানা কাব্যপুঁথিতে পতিতা-সংস্কৃতির সরস বিবরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলা কথাসাহিত্যে পতিতা-প্রসঙ্গ আসার বেশ আগেই নকশাজাতীয় রচনায় পতিতার কথা ও কাহিনী স্থান পেয়েছে।
কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নক্সায় উনিশ শতকের কলকাতার ‘পতিতবৃত্তির সরস বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর এ প্রসঙ্গে উল্লখযোগ্য প্রহসনগুলো হল ‘আজব শহর কলকেতায় ‘খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা’। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের পতিতামগ্ন পুরুষের চালচিত্র কেমন ছিল তার বিবরণ সেকালের অনেক খ্যাতকীর্তি মানুষের স্মৃতিচর্চায় পাওয়া যায়। এ থেকে পতিতা-সংস্কৃতির সামাজিক চিত্রের নিপুণ পরিচয় মেলে। ওই সময়কার সাহিত্যে বৈধব্যের ফাঁদে পড়ে হিন্দু মেয়েদের পতিতা হবার প্রচুর কাহিনী রয়েছে। মনীষী রাজনারায়ণ বসু তাঁর সে কাল আর এ কাল-এ উল্লেখ করেছেন ,তা ছাড়া দীনেন্দ্রকুমার রায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, গ্রামীণ মেলা বা আড়ং-এও পতিতার ‘টঙ্’ জাঁকিয়ে বসতো। তাদের শিকার ছিল মোহিনী-মায়ায় মুগ্ধ গ্রামের চাষাভূষো ও সাধারণ মানুষ।
নদীয়ার মহারাজার দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায় তাঁর আত্ম-জীবনচরিত-এ ‘গণিকালয়ের ইতিহাস’ নামে একটি উপ-অধ্যায়ে এ-বিষয়ে কৌতূহল-জাগানো তথ্য ও কাহিনী পরিবেশন করেছেন। উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক চিত্র আঁকতে গিয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইয়ে কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিবরণ তুলে দিয়ে ভিন্ন কাহিনীও শুনিয়েছেন : ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ থেকে ‘কাটছাঁট’ করে রমাকান্ত চক্রবর্তী যা উদ্ধৃত করেছেন এই তথ্য সমর্থনের জন্য তা-ই যথেষ্ট : নগরনটীরা ‘বাবু’দের বশে রাখতেন কোন মন্ত্রে, সেই বিবরণ দিয়েছেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নববাবুবিলাসে।এছাড়াও আমরা বিক্ষিপ্তভাবে অবশ্য উনিশ শতকের সেই চিত্র কিছু কিছু পেয়েছি হুতোম পেঁচার নকশায়, একেই কি বলে সভ্যতা কিংবা বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ পড়ে। পেয়েছি বিক্ষিপ্তভাবে কলকাতায় বাবু শ্রেণীর উদ্ভবের ইতিহাসের পাঠে বিনয় ঘোষের বাংলার ইতিহাসের সমাজচিত্র থেকে।
পতিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.........ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিরে ভুলাতে
পাঠাইলে বনে যে কয়জনা
সাজায়ে যতনে ভূষণে রতনে,
আমি তারি এক বারাঙ্গনা।
দেবতা ঘুমালে আমাদের দিন,
দেবতা জাগিলে মোদের রাতি--
ধরার নরক-সিংহদুয়ারে
জ্বালাই আমরা সন্ধ্যাবাতি।
তুমি অমাত্য রাজসভাসদ
তোমার ব্যাবসা ঘৃণ্যতর,
সিংহাসনের আড়ালে বসিয়া
মানুষের ফাঁদে মানুষ ধর।
আমি কি তোমার গুপ্ত অস্ত্র?
হৃদয় বলিয়া কিছু কি নেই?
ছেড়েছি ধরম, তা ব'লে ধরম
ছেড়েছে কি মোরে একেবারেই।
নাহিকো করম, লজ্জা শরম,
জানি নে জনমে সতীর প্রথা--
তা বলে নারীর নারীত্বটুকু
ভুলে যাওয়া, সে কি কথার কথা?
পতিতা-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ অসহিষ্ণু ও সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে জগদীশ গুপ্তের (১৮৮৬-১৯৫৭) ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের আলোচনায়। ‘লঘু-গুরু’র ‘জজিয়তী’তে রবীন্দ্রনাথ কাহিনীর সম্ভাব্যতা ও সেইসঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে নৈতিকতার প্রশ্নটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই উপন্যাসে লেখক হিসেবে জগদীশ শক্তি ও সাহসের যে-পরিচয় দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তা স্বীকার করে নিয়েও লেখকের উদ্দেশ্যের সমালোচনায় বিরত থাকেননি। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেও একসময় সাহিত্যে অশ্লীলতা বা ‘গণিকার প্রেম’ আনয়নকারী হিসেবে অভিযুক্ত ও সমালোচিত হয়েছিলেন (‘সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা’, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, কলকাতা, ১৯২২)।
রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) পরের প্রজন্ম থেকে গল্প-উপন্যাসের প্রসঙ্গ ও প্রকরণে যে মৌলিক পরিবর্তন দেখা দিল, তাতে একদিকে যেমন নিম্নবর্গের হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ অপরদিকে সংসারবিচ্যুত নারী যারা পতিতা-কুলটা-অসতী অভিধায় চিহ্নিত ধীরে ধীরে কথাসাহিত্যের ভুবনে তারা ঠাঁই করে নিতে লাগল। এই প্রসঙ্গে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট রাজলক্ষ্মী চরিত্রটিও উল্লেখ করতে হয়। সাহিত্যের ভুবনে এই অবিদ্যাদের অবাঞ্ছিত বলে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা থাকলেও কারো কারো জীবনে তারা সাদরে গৃহীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের বিষয়বস্তুও শ্রেষ্ঠ হবে এ নীতি থেকে প্রথম অন্যধারায় সরে আসেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। প্রথম মহাসমর-উত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল, তা থেকে ভারতবর্ষও রক্ষা পায়নি। তখন মানুষের জীবনধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। শ্রম বিনিয়োগ করে জীবিকা উপার্জনের উপায়ও ছিল না। গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ বেঁচে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে শহরমুখী হয়েছিল। কিন্তু শহুরে বাস্তবতা আরো ভয়ানক। সে সময় অনেক নারী যৌনকর্মী হিসেবে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার পথ বেঁচে নেন। তারা বলতেন, দেহটাকে দিয়ে শরীরটাকে বাঁচাই। এরূপ জীবন-মরণ বাস্তবতা থেকে নারীদের বাঁচার চেষ্টাকে যারা হীন অর্থে ব্যাখ্যা করেছে, তাদের উদ্দেশে
কবি নজরুল বলেছেন,
বারাঙ্গনা
কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে ?
হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে !
নাই হ'লে সতী তবু ত তোমরা মাতা-ভগিণীরই জাতি,
তোমাদেরই ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদের জ্ঞাতি ;
আমাদেরই কোনো বন্ধু স্বজন আত্মীয় বাবা কাকা
উহাদের পিতা, উহাদের মুখে মোদেরই চিহ্ন আঁকা !
অথবা,
পতিতা
আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে – সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়;
প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে
রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!
সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের পর!
চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী-
মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় – সে যে নারী, সে যে নারী!
জীবনানন্দ দাশ
জাত-পতিতা, ভদ্র-পতিতা কিংবা ছদ্ম-পতিতাদের মধ্যে দু-চারজন সাহিত্যচর্চাও করতেন- কেউ আবার নিজের জীবনকথাও লিখেছেন। এসব রচনায় পতিতাদর জীবনের অন্তরঙ্গ কাহিনী- তাঁদের ঘরোয়া জীবনের চালচিত্র প্রতিফলিত। এই ধরনের আত্মকথা সময়ের বিশ্বস্ত সামাজিক দলিল হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। অন্ধ গলির নারকীয় ভুবনের এসব কাহিনী নাটকীয় ঘটনায় পূর্ণ, কখনো বা উপন্যাসকেও হার মানায়। এই ধরনের বইয়ের মধ্যে সেকালের বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী নটী বিনোদিনীর আমার কথা (১৩১৯), মানদা দেবীর শিক্ষিতা পতিতার আত্ম-চরিত (১৩৩৬), তিনকড়ি দাসীর আমার জীবন (১৯০০)-এর কথা উল্লেখ করা যায়। বিদ্যাদর্শন (৫ম সংখ্যা, ১৮৪২) পত্রিকায় ‘কলিকাতা নিবাসিনী বেশ্যা’র পত্র কিংবা রূপ ও রঙ্গ (১৫ কার্তিক ১৩৩১ ও ২২ কার্তিক ১৩৩১ পত্রিকায় অভিনেত্রী অরুন্ধতী ও সৌদামিনীর ছদ্ম-পরিচয়ের আত্মকথায় অবিদ্যা-জীবনের বেদনার করুণ কাহিনী বিবৃত হয়েছে। অবিদ্যাপাড়ার অভিনত্রেী সুকুমারী দত্তের আত্মজৈবনিক নাটক অপূর্ব্বসতী নাটক (১২৮২)-এর কথাও এখানে বলতে হয়।
সাম্প্রতিককালে অবিদ্যার অনন্তপুরে চমকপ্রদ এক গবেষণার কথা পাওয়া যায় বাংলাদেশের ড. আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘অবিদ্যার অনন্তপুরে’। এ গ্রন্থে তিনি ‘নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ তুলে ধরতে গিয়ে এমন কিছু দুর্লভপ্রায় রচনা সংকলিত করেছেন, যা একইসঙ্গে একটি কালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি সাহিত্যিক ইতিহাসের উপকরণ উন্মোচিত করেছে একালের পাঠকের কাছে। ‘অবিদ্যার অনন্তপুরে’ বইটি মোট সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম ভূমিকা, আমার কথা : বিনোদিনী দাসী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত : মানদা দেবী, ব্যভিচারী রমেশদা’র আত্মকথা : রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অপূর্ব্বসতী নাটক : সুকুমারী দত্ত এবং পরিশিষ্ট অংশে দুটি অধ্যায় কলিকাতা নিবাসিনী বেশ্যার পত্র ও বারবণিতার উইল। আবুল আহসান চৌধুরী সংকলিত ‘বিনোদিনীর কথা’র যে সংস্করণ এ-গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তার প্রকাশক ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী’, প্রকাশকাল ১৩২০ বঙ্গাব্দ। এটি নব সংস্করণ। তার অর্থ প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত এই নব সংস্করণের আগেও সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক বিবেচনা করলে সে যুগের এক বারবণিতার এ ধরনের আত্মজীবনী প্রকাশ বাংলা সাহিত্যের এক অতি দুঃসাহসী ঘটনা, মানতেই হবে। নৃত্যগীত এবং অভিনয়ে দক্ষ বিনোদিনী যে রূপে-গুণে সমান পারদর্শিণী তা তার ছবি দেখে যেমন এক পলকে জানা হয়ে যায়, তেমনি তার জীবনসংগ্রামের বর্ণনা পড়লে, তার অভিনয়ের অভিজ্ঞতার স্তরগুলো পেরিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর বর্ণনায় উপলব্ধি শুধু নয়, বিস্ময়ে থ’ হয়ে যেতে হয়। যে কালপরিসরে উল্লেখিত চরিত্রেরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা লিখেছেন, তাতে বাংলা সাহিত্য- অঙ্গনের এমন অনেক নামজাদা চরিত্রের উপস্থিতি ঘটেছে, এমন সামাজিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে, যার সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্য ইতিহাসের নিরিখে অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের জীবনের গল্পটা হচ্ছে প্রতি দিনই একটি ইতিহাসের দিকে ধাবিত হওয়া৷ একটি স্মৃতিতে ডুবে যেতে থাকা৷ কেউ স্বচ্ছ আকাশে ভাসমান মেঘ দেখে মাটিতে দাঁড়িয়ে৷ আবার কেউ প্রতিটি ভোরের সূর্যস্নান করে বেদনায়, নিষ্পেষণে ৷ সাহিত্য জীবনকে তো সেই বাস্তবতার পরশই দেয়৷ যে সাহিত্য যতো বেশী সাধারন মানুষের কাছে মনোগ্রাহী হয়, সেই সাহিত্যকে ততো বেশী বাস্তবনির্ভর বলা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যে সে বাস্তবতার অভাব নেই বলেই বাংলা সাহিত্য এত সমৃদ্ধ।৷
কলকাতা ।
সুচিন্তিত মতামত দিন