শ্রীশুভ্র








"দ্বিখণ্ডীত ভূবন"



একবিংশ শতকের বাংলা আর একবিংশ শতকের বঙ্গনারী উভয়েই দ্বিখণ্ডীত! আবিশ্ব পিতৃতন্ত্রের সমাজ বাস্তবতায় বঙ্গনারীর অস্তিত্ব আজ দ্বিখণ্ডীত! জাতি হিসেবে বাঙালি আজ দ্বিখণ্ডীত বলে নয়! আধুনিকতার ছোঁয়া আর পিতৃতন্ত্রের ঘেরাটোপ, এই দুই বিপরীত ঘূর্ণাবর্তে পড়ে বঙ্গনারীর এই দ্বিখণ্ডন! এই অবস্থা কাঁটাতারের উভয় পার্শ্বেই! এই অবস্থা উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমাজ বাস্তবতাতেই সত্য! এই অবস্থা আর্থিক শ্রেণী বৈষম্যের সকল গণ্ডীতেও সত্য! স্বাধীনতার পর থেকে গত ছয় দশকের সময় সীমায় বহু পরিবর্তনই ঘটে গেছে বাংলার সমাজ জীবনে! যে পরিবর্তনের ছোঁয়া নারীর জীবনকেও প্রভাবিত করেছে আগাগোড়া! সেই পরিবর্তনের সূত্রেই গড়ে উঠেছে আজকের বঙ্গসমাজ! আধুনিক বাংলায় সবচেয়ে বড়ো ঘটনা দেশভাগ এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধ! বাংলার সমাজ জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরাসরি প্রভাব বিশেষভাবে পড়েনি! কিন্তু দেশভাগের ফলে আর্থসামাজিক পট পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবেই পড়ল বঙ্গনারীর জীবনে! অন্দরমহলের চৌহদ্দি থেকে বেড়োতে হল তাকে! একান্নবর্তী পরিবার ভাঙ্গতে থাকার সাথে শিক্ষার বিস্তার ও জীবিকার সন্ধানে নারীকেও আসতে হল পুরুষের জগতে! নামতে হলো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে! দেখতে পেল নারী, পুরুষের থেকে বিদ্যা বুদ্ধি সৃজনশীলতায় সে কোনো অংশেই কম নয়! চমকে গেল আপন শক্তির অনন্ত সম্ভাবনার সরূপ উদ্ঘাটনে! শুরু হল এক নতুন যুগের! শুরু হল অনন্ত পথচলা! নিরন্তর নিজেকে আবিষ্কার!


শিক্ষার বিস্তার ও জীবিকানির্বাহের সূত্রে নারীর স্বাধিকারবোধে এল যুগান্তর!আশাআকাঙ্খা ভালোবাসার অনুষঙ্গগুলিতে এল আধুনিকতা! কিন্তু চিন্তার বিস্তারে বিশেষ কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটলো না! কারণ সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ জীবনের ঘেরাটোপ! পুরুষশাসিত সমাজ জীবনে আজও  নারীর মূল্য নির্ধারিত হয় যৌন তৃপ্তি দানের এবং গর্ভধারণের সক্ষমতায়! ফলে এইযে পুরুষের চোখে নারীর গুরুত্ব দুইটি মাত্র ক্ষমতার পরিসরে সীমাবদ্ধ; নারীর চেতনাও সেই প্রেক্ষিত থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি! শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে জীবনের নানান অনুষঙ্গে আশা আকাঙ্খার পরিধির বিস্তার ঘটলেও পুরুষের চোখে নারী তার গুরুত্বের নতুন কোনো ভুবন গড়ে তুলতে পারেনি আজও! ফলে আর্থিক স্বনির্ভর নারীদের অবস্থা অনেকটা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো! একদিকে স্বাধিকারবোধ চর্চা করার মতো আর্থিক স্বাধীনতা এবং অপরদিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবতায় পুরুষের চোখে নারীত্বের মহিমা বজায় রেখে চলা! এই দুই ভূমিকায় ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে দ্বিখণ্ডীত নারীসত্তা অন্তর দহনে দগ্ধ হতে থাকে প্রায়ই! যদিও অধিকাংশ স্বাবলম্বী নারীই পিতৃতন্ত্রের মূল শর্তগুলিকেই নারীত্বের পরম বিকাশ বলে মনে করে! ফলে তারা পুরুষের যৌন তৃপ্তি দেওয়ার মধ্যেই এবং পুরুষের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার সক্ষমতাকেই নারী জীবনের পরম সার্থকতা বলে মেনে নেয়! এভাবেই তারা নারীবাদী সত্তা ও পিতৃতন্ত্রের মধ্যে সহাবস্থানের আপোষ করে নেয়!


সমাজ ও সংস্কৃতি পুরুষতন্ত্রের শর্তগুলিকে শৈশব থেকেই নারী চেতনায় প্রথিত করে দেয়! সেইখান থেকেই গড়ে ওঠা নারীবোধে নারীও পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে ঢালা জীবনবোধে নারীর মূল্য অনুধাবন করে! কিন্তু এর বাইরে স্বঅভিভাবিকা কোনো নারী যখন প্রচলিত প্রথার বাইরে এসে দাঁড়াতে চায় স্বভাবতই সমাজ তখন এক বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে! সেও এক সমস্যা! কিন্তু তার চেয়েও বড় সর্বনাশ ঘটে নারী যখন একদিকে স্বঅভিভাবকত্ব জনিত অর্জিত স্বাধিকারবোধের স্বাধীন ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হয়েও ঘরেবাইরে পুরুষতন্ত্রের চাপানো শর্তগুলিকেও মেনে নিতে চায়! গণ্ডগোলের সূত্রপাত হয় তখনই! অন্তরে দ্বিখণ্ডীত সত্তার ভার ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে তার জীবনের শান্তি! ঠিক একই সর্বনাশ ঘটে যখন, ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবোধে দীপ্যমান কোনো নারী আর্থিকভাবে পরনির্ভরতার কারণে পুরুষতন্ত্র দ্বারা চালিত হতে বাধ্য হয় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য! এই দুই বিপরীত অবস্থানেই স্বাধীন নারী সত্তা অন্তরের দ্বিখণ্ডনের দগ্ধজ্বালায় দীর্ণ হতে থাকে! পুড়তে থেকে
তার চেতন অবচেতনের স্বাধীন ক্যানভাস!  বহুক্ষেত্রেই এই অবস্থায় পড়লে মানসিক স্থিতিতে সৃষ্টি হওয়া আবর্তে নারীর স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে যায় নানান ভাবে! কিন্তু প্রশ্ন হল এই দ্বিখণ্ডনের আবর্ত থেকে কি করে রক্ষা পাবে ব্যাক্তি নারীসত্তা? তার জন্য আত্মনির্ভরতার পথে অগ্রসর হয়ে অর্জন করতে হবে এমন এক আত্মপ্রত্যয় যা হিমালয়ের মতো অটল! বিন্ধ্যের মত দৃঢ়!


এই যে নারী জীবনের দুইটি ভূবন, একদিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আশ্রিত জীবন ও অন্যদিকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধে প্রদীপ্ত নারীত্ব, এই দুইয়ের টানা পোড়েন থেকে মুক্তির উপায় নারীকেই খুঁজে নিতে হবে! অনেকেই বলবেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে থেকেই তো আধুনিক নারী, জীবনের সকল স্বাধীনতার চর্চা চালিয়ে যেতে পারে! পারে হয়ত! কিন্তু সমাজের মাত্র কয় শতাংশ নারীর পক্ষে তা সম্ভব? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে সমাজে, কর্মক্ষেত্র থেকে স্নেহ মায়ার হৃদয় চর্চায়, সর্বত্রই পুরুষতন্ত্রের সাথে আপোষ করে চলতে পারার মধ্যেই নারীর ব্যক্তিজীবনের সুস্থিতি নির্ভর করে! অর্থাৎ এই আপোষের মানসিকতাই যেন নারীত্বের সমার্থক! সেই শিক্ষাই দেওয়া হয় নারীকে!  অর্থাৎ এই যে কেবল মানিয়ে নিয়ে চলার শিক্ষা, নিজের বিশ্বাস মূল্যবোধ আশা আকাঙ্খার বিপ্রতীপ অবস্থানকেও কেবল মানিয়ে নিয়ে চলাই নারীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম; সেই শিক্ষা দিয়েই নারীর মানসিকতার ভূবনকে গড়ে তোলে পুরুষতন্ত্র! এবং নারীর পারিবারিক ও সামাজিক বিন্যাসে সেও তার বিশ্বাসে একেই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়! এইভাবেই মানসিক সুস্থিতির বলয়ে বাস করে জীবন কেটে যায় অধিকাংশ নারীর! কিন্তু পুরুষতন্ত্রের এই ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসে এই বিশ্বাসগুলোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে যে নারী, স্বভাবতই সে সমাজে ব্রাত্য হয়ে পড়ে! অন্তরে সেও দ্বিখণ্ডনের জ্বালা অনুভব করে যখন সেও পুরুষতন্ত্রের সাথে কার্যক্ষেত্রে আপোষ করে চলতে বাধ্য হয়!


নারীর এই দ্বিখণ্ডীত সত্তার অন্তরে বাইরে চলতে থাকা সামুহিক বিপর্যয়ের মধ্যে যে যন্ত্রণার তীব্রতা ব্যাক্তি জীবনের পরতে পরতে বিপর্যস্ত করতে থাকে স্বাভাবিক শান্তি ও নিরাপত্তা; সেই তীব্র বিপর্যয় পাড় হয়ে নিজের জন্য একান্ত একটি
সম্পূর্ণ মানবিক ভূবন গড়ে তোলা সকলের পক্ষে সহজ নয়! সহজ নয় বলেই অধিকাংশ নারী জীবনই শেষমেশ ঐ পুরুষতন্ত্রের কাছেই অসম্পূর্ণ জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নেয়! আর সেখানেই ঝরে যায় বঙ্গনারীর জীবন ভাবনায় নারীস্বাধীনতা নারীবাদের বিভিন্ন অনুষঙ্গগুলির সকল সম্ভাবনার অর্ধস্ফূট কূঁড়ি! এবং এইভাবেই মূলত আবহমান পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ  রক্ষা হয়ে চলেছে বঙ্গজীবনের সকল সম্প্রদায় সকল শ্রেনীর পরিসরে!


বর্ধমান ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.