অনন্যা ব্যানার্জী









শক্তি চট্টোপাধ্যায় – বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র






ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
~~~~~~~~~~~~~~
( শক্তি চট্টোপাধ্যায় )


কবিতা কার ? কবির একান্ত একার নাকি পাঠকের জন্যই লেখা ? নাকি কবির ব্যাক্তিগত খামারের ফসল ? নাকি কবিতা আসলে দেশ কাল সমাজের প্রয়োজনীয় উপাদান ? নাকি সর্বোপরি কোনও মানুষের তরে সকল ভালোবাসার সম্প্রদান ?
কিছু কিছু কবিতা আছে যা কবিতা হিসাবে যেমন সার্থক তেমনই তারা আপামর বোধের ভালোলাগার দরজা খুলে ঢুকে পরে হাজার মর্মে । সেই সমস্ত কবিতার স্রষ্টাদের জানাই কুর্নিশ । কুর্নিশ জানাই সেই সমস্ত কবিদের যাদের কবিতায় আবেশিত হয়েছে হাজারো কবিতা বিহীন জীবন যাপন ।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় এমনই এক কবি । গত শতকের পাঁচের দশক থেকে উঠে আসা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে । দেশ কাল সমাজের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি মিশে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মে । একদিকে তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে তৎকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি , ঠিক তেমনই অপর প্রান্তে রয়েছে ভালোবাসার জয়ধ্বনি।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জয়নগর মজিল পুরের দরিদ্র ব্রাম্ভণ পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন । দারিদ্র্যের কারনে তিনি স্নাতক পাঠ অসমাপ্ত রেখেই প্রেসিডেন্সী কলেজ ছাড়েন এবং সাহিত্য কে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে তিনি উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন । তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’ । কিন্তু আড়াই বছর চাইবাসায় থাকবার সময় তিনি কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন । এবং একজন সফল লিরিক্যাল কবিতে পরিণত হন । তিনি নিজের কবিতা কে বলতেন পদ্য ।
এর পর ষাটের দশকের শুরুতেই সাহিত্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে ‘হাংরি আন্দোলন’ । এই বিখ্যাত ‘হাংরি আন্দোলন’ এর অন্যতম পথ প্রদর্শক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । পরবর্তীতে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর মতবিরোধ হওয়ায় তিনি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী তে যোগদান করেন । পরবর্তী কালে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কৃত্তিবাসের কবি হিসাবে সুনীল ও শক্তি – র নাম একত্রে উচ্চারিত হতে লাগলো ।
এদিকে একক ভাবে প্রকাশিত হতে লাগলো তাঁর বিভিন্ন কাব্য গ্রন্থ । তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ গুলি হল --
     
*      এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২)
ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭)
সোণার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮)
অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮)
হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯)
চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০)
পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১)
প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২)
সুখে আছি (১৯৭৪)
ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫)
অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫)
জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫)
ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫)
সুন্দর এখানে একা নয় (১৯৭৬)
কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬)
ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯)
আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০)
প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১)
যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩)
কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫)
ও চির - প্রণম্য অগ্নি (১৯৮৫)
মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয় (১৯৮৫)
সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬)
এই তো মর্মর মুর্তি (১৯৮৭)
বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮)
আমাকে জাগাও (১৯৮৯)
ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১)
জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪)
বড়োর ছড়া (১৯৯৪)
সেরা ছড়া (১৯৯৪)
টরে টক্কা (১৯৯৬)
কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭)
সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯)
পদ্যসমগ্র - ১ম থেকে ৭ম খণ্ড

শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুন্য পঞ্চাশ টি কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা , প্রায় আড়াই হাজারের মত কবিতা রচনা করেছেন তিনি । তাঁর কবিতার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই যে কবিতা টির কথা চলে আসে তা হল –

অবনী বাড়ি আছো?
অবনী বাড়ি আছো?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

এছাড়াও তাঁর অন্যতম কয়েক টি জনপ্রিয় কবিতা হল –

চাবি
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো !
থুৎনি 'পরে তিল তো তোমার আছে
এখন ? ও মন, নতুন দেশে যাবি ?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো ।
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো--
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু - ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?
চতুর্দশপদী কবিতাবলী
ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।

প্রভৃতি কবিতায় উঠে এসেছে তাঁর চেতনা , বাস্তব বোধ , মানুসেরপ্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা। এরকম হাজারো কবিতায় তিনি ছুয়ে গেছেন অগুনতি কবিতা বিহীন জীবন । ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে মার্চ কবি তীর্থ শান্তিনিকেতনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন হাজারো পাঠকের অভ্যন্তরে, তাই আজও নিভৃতে নির্জনে রাতের আঁধারে আমদের হৃদয় থেকে প্রতিধ্বনিত হয় রাতের কড়া নাড়া ।।


কলকাতা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.